জালাল আহমেদ
দু’তিন চ্যাংরা হাতি ধাক্কা দিয়ে বাসটা খালে ফেলে দিতে চেষ্টা করলো

১৯৮৪ সালের আগস্ট মাসে বর্ষাকালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক আবার এলেন খাগড়াছড়ি সফরে, তারিখটা সম্ভবত ৭ আগস্ট। আবারো হৈ চৈ, তুমুল প্রস্তুতি। এরমাঝে চিঠি পেলাম ৮ তারিখে আমাদের বিভাগীয় পরীক্ষা। অনেকেই জানেন যে শিক্ষানবীশ কালের অন্যতম করণীয় হল বিভাগীয় পরীক্ষার ৪ পত্রের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, এটা চাকুরী স্থায়ীকরণের অন্যতম শর্ত। কিন্তু সিএমএলএ এর ভিজিট সামনে রেখে পরীক্ষার কথা বলারও পরিবেশ নেই, আর রাব্বী স্যারের মতো ডিসি। তাই আমরা সবাই পরীক্ষা দিতে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে রাখলেও মন দিয়ে ভিভিআইপি ভিজিট সফল করার কাজেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ভিজিট শেষে এরশাদ সাহেব চলে গেলেন। উল্লেখযোগ্য কোন বিচ্যুতি ছাড়া সফর সফল হওয়াতে জেলা প্রশাসক ও এসজেডএমএলএ দু’জনেই হালকা মেজাজে ছিলেন। জেলা প্রশাসক ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে গেলেন সংগে আমিও গেলাম এবং ব্রিগেড কমান্ডার এর সামনেই বললাম যে স্যার, কাল আমাদের বিভাগীয় পরীক্ষা, অনুমতি পেলে ঢাকায় যেতে পারি। শিক্ষানবীশ কর্মকর্তার বিভাগীয় পরীক্ষার গুরুত্ব জেলা প্রশাসক মহোদয়ের জানা, তাই তিনি সম্মতি দিলেন। এসজেডএমএলএ বললেন যে যাবেন কিভাবে? ডিসি সাহেবকে বললেন যে একটা গাড়ি দিয়ে দেন। ডিসি সাহেব তাতেও সম্মতি দিলেন তবে মহাসড়ক, মানে বারৈয়ারহাট পর্যন্ত।
আমি ফিরে আসলাম, সবাই রেডিই ছিল, আমরা যাত্রা শুরু করলাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। মিতসুবিশি জীপ, চালাচ্ছে তখনকার এনডিসি ম্যাজিস্ট্রেট নজরুল (তাঁর সংগে বর্তমানে কোন যোগাযোগ নেই)। ফ্রন্টসিটে আমি আর মোঃ গোলাম রাব্বানী। রুহুল আমিনসহ আরো কেউ ছিল। বৃষ্টি হচ্ছিল বেশ জোরেশোরে। মাটিরাঙ্গা যখন পার হই তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গিয়েছে। মাটিরাঙ্গা পার হয়ে মিনিট পাঁচেক এসেছি, গাড়ি একটু উপরে উঠছে, একটা বামে মোড় নিয়ে আবার ডানে মোড় নেবার পরই দেখি সামনে রাস্তা জুড়ে এক হাতি! গাড়ি সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক করলো, আমি সামনের সিটে জানালার পাশে, বামে তাকাচ্ছি কোন বড় গাছ আছে কি না আর হাতে জুতো খুলছি। হাতি ছিল আমাদের দিকে পেছন ফিরে। একবার ডানদিকে মাথা ঘুরিয়ে আমাদের দেখে নিল তারপর সামনের দিকে দ্রুত হেঁটে গেলো। গাছপালার শব্দে মনে হলো সামনে কোথাও পাহাড়ে উঠে গিয়েছে। আমরা মিনিট কয়েক অপেক্ষা করলাম তারপর নজরুল আবার এক্সেলেটরে পা দিল। ধীরে ধীরে ১০০ মিটার এগুনোর পরে দূরে রাস্তার পাশে হাতি উপরে উঠে যাবার চিহ্ন দেখে আমরা এগিয়ে গেলাম। একা হাতি দেখে আমার ধারনা হল যে এটা দলের পেছনে হাঁটা সেই পাগলা হাতি। প্রচন্ড বৃষ্টি, তারমাঝেই গাড়ি চালিয়ে বারৈয়ারহাট, কিন্তু এই বৃষ্টিতে কোন গাড়ি থামিয়ে উঠা যাবে এমন মনে হল না। সিদ্ধান্ত হল জীপ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। বৃষ্টির মাঝেই রাত দু’টোর দিকে কুমিল্লা শহরে পৌঁছাই। তখন ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক কুমিল্লা শহরের ভেতর দিয়ে যেতো। শহরের শাসনগাছা রেলক্রসিংয়ে একটা ঢাকার বাস পাওয়া গেল যাতে সিটও আছে। আমরা জীপ ছেড়ে বাসে উঠলাম, চালক গাড়ি নিয়ে খাগড়াছড়ি ফিরে যাবে এই নির্দেশ দিয়ে। পরদিন ভোরে ঢাকা পৌঁছে সরাসরি ঢাকা কলেজে আমার পরীক্ষার হলে চলে গেলাম।
পরীক্ষা শেষে সবাই যার যার মতো ঢাকা থেকে ফেরার কথা। তারিখ মনে নেই, সম্ভবতঃ ১১ আগস্ট ১৯৮৪ ফিরছি ফেনী হয়ে বাসে। আমি সাধারণতঃ ঢাকা থেকে দুপুরে রওয়ানা দিয়ে ফেনীতে রাত কাটাতাম বিকেলে পাহাড়ি রাস্তায় ভ্রমন এড়ানোর জন্য। ফেনী থেকে সকালের বাসে যাত্রা শুরু করে দুপুরের দিকে যখন মাটিরাঙ্গার কাছাকাছি তখন দেখি রাস্তা দিয়ে লাইন ধরে লোক যাচ্ছে। পাহাড়ী লোকজনের হাতে দা-ঝুড়ি। বুঝতে পারছিলাম না যে বিষয়টা কি! একটু পরে বাসের হেল্পার বল্ল যে একটা হাতি মারা গেছে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামাতে বললাম, জেলার কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্বও আছে। নেমে লাইনে ঢুকে রাস্তার পাশেই টিলার উপরে উঠলাম। উঠে একটু সামনেই দেখি যে একটা তরুণ হাতি মরে পড়ে আছে। তার চারপাশে অসংখ্য হাতির পায়ের ছাপ। মাথার উপরে বিদ্যুতের লাইন। আগের সপ্তাহে খাগড়াছড়িতে বিদ্যুতের গ্রীড লাইন উদ্বোধন করেছেন সিএমএলএ। লাইন উদ্বোধনে হাতি সমাজের সম্মতি নেয়া প্রয়োজন একথা তখনো কেউ অনুধাবন করেননি, এখনো করেন না। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ট্রেন লাইন বানাতে গিয়েও আমরা একাধিক হাতি চলাচলের পথে বাঁধা সৃষ্টি করছি, ঐ পথেও রেললাইন হবে হাতিদের মরণ ফাঁদ। হাতির চলাচলের পথে এগুলো নতুন স্থাপনা। হাতি যে কারণে সেটলার্স ভিলেজে হামলা করতো, যে কারণে অচেনা বলে কাঁঠাল গাছ ভেঙ্গে ফেলতো একই কারণে তারা বিদ্যুৎ এর লাইনের উপরও ক্ষুব্ধ ছিল। অথবা ওই তরুণ হাতি কৌতুহলবশতঃ শুড় দিয়ে বিদ্যুৎ এর লাইভ ওয়্যার ধরতে গেছে ও মারা পড়েছে। তার সঙ্গীরা রাতভর তাকে তোলার ও নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। একটা জীবন দিয়ে এই দলটার শিক্ষা হল যে বিদ্যুতের তাঁর স্পর্শ করা যাবে না।
পাগলা হাতির অত্যাচার চলতেই থাকলো। এদিকে হাতির দল নতুন বসতিগুলোতে হামলা করছিলো। একদিন গুইমারা ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার সেন্ট্রি পোস্টের সামনে, গুইমারা খালের বেইলী সেতুর আগে একটা বাস অকেজো হয়ে পড়ে ছিল। হাতির পাল আসলো সেখানে, সেন্ট্রিদের চোখের সামনে দু’তিন চ্যাংরা হাতি চেষ্টা করলো ধাক্কা দিয়ে বাসটা খালে ফেলে দিতে। বাসের ভেতর দুই হেলপার রাত কাটাচ্ছিল। তাদের তখন ত্রাহি মধুসূদন! সর্দার হাতি এসে তাদের সরিয়ে নিয়ে গেল, তারা তখন চেষ্টা করলো বেইলী সেতু ভেঙ্গে ফেলার। ব্যর্থ হয়ে সেতু পার হয়ে চলে গেল। একসময় সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে খেদা করে হাতি ধরা হতো। সিলেট এর বিখ্যাত কালেক্টর উইলিয়াম ম্যাকপিস থ্যাকারে আবার হাতি ধরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছেই বিক্রি করেছিলেন। হাতির দাম নিয়ে মতানৈক্যের কারণেই থ্যাকারে উইথড্র হন। আরেক বিখ্যাত কালেক্টর রবার্ট লিন্ডসে এই ভুল করেননি, তিনি হাতি ধরে বিক্রি করতেন বিহারের বিখ্যাত শোনপুর মেলায়। লিন্ডসে যখন ১২ বছর কালেক্টরশীপের পর যথেষ্ট হয়েছে ভেবে ১৭৮৯ সালে ভারত থেকে চলে যান তখনো ওই বছরের শোনপুরের মেলার হাতি বিক্রির ‘সেল প্রসিড’ পাননি। ৬ মাস পরে ইংল্যান্ডে বসে ঐ টাকা পাবার পর তিনি ভারতীয়দের সততার প্রশংসা করেছিলেন। এখনো দেশের সবচেয়ে বেশি পোষা হাতি সিলেটে। ফলে ১৯৮৪ সালেই বনবিভাগ সিলেটের একটা পেশাদার দলকে হাতি ধরার জন্য নিয়োগ করে। তারা ৫টি হাতি ধরেছিলো। মেইন রোডের পাশে মোটা দড়ি দিয়ে চার’পা ও কখনো কখনো শুড় বাঁধা এই হাতিদের দেখে অনেক দিন মন খারাপ হয়েছে আমার!