জালাল আহমেদ
বাংলাদেশের বেশীর ভাগ অফিসার দুর্বল হয় পোস্টিং এর ভয়ে

মেধা তালিকায় ১২তম অবস্থানে থেকেও খাগড়াছড়ি পোস্টিং এ মনটা খারাপই হলো। কোন জেলা সদরে না হয়ে এক পা-ববর্জিত মহকুমা সদরে। আমার মাস্টার্স পরীক্ষা নিয়েও আমি চিন্তায় ছিলাম। তখন বিভাগে নতুন চেয়ারম্যান, কটুভাষী বলে খ্যাত প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মহব্বত খান। তিনি বললেন মাস্টার্স বা চাকরি, দু’টি এক সঙ্গে হবে না। আমাকে সাহস যোগালেন দু’জন, একজন কোর্স পরিচালক কাজী সিরাজুল হোসেন, তিনি বললেন দেশ স্বাধীন না হলেতো ডেরা গাজী খাঁ বা ডেরা ইসমাইল খাঁ পোস্টিং হতে পারতো তাই শুকরিয়া করো যে তুমি স্বাধীন বাংলাদেশের বাসিন্দা। আরেকজন শাহ আব্দুল হান্নান, তিনি বললেন বাংলাদেশের বেশীর ভাগ অফিসার দুর্বল হয় পোস্টিং এর ভয়ে। তুমি শুরুতেই খাগড়াছড়ি চাকরি করে আসলে তোমার আর পোস্টিং নিয়ে ভয় থাকবে না। তখনতো জানি না যে এর চেয়ে খারাপ পোস্টিং এও কাজ করতে হবে। ফলাফল তাই হয়েছিল যে আমি জীবনে কখনো পোস্টিং খুঁজে নেইনি এবং কোন পোস্টিং এর জন্য কখনো কোন আপোষও করিনি।
প্রশ্ন হলো খাগড়াছড়ি যাবো কিভাবে? কেউ কি জানে খাগড়াছড়ি কিভাবে যেতে হয়? খাগড়াছড়ি গিয়েছেন এমন একজনকেও পাওয়া গেলো না। একজন মাত্র পাওয়া গেলো যিনি শুধু যাবার রাস্তা চেনেন। এস এম ইসহাক হাসান, আমাদের সঙ্গেই কোটায় ছিলেন পরে চাকরি হারিয়েছেন মেডিক্যালী আনফিট হওয়াতে, বাড়ি ফটিকছড়ি। উল্লেখ্য আমাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছিল চাকরিতে প্রবেশের পর। তিনি বললেন যে হাটহাজারী থেকে ছেড়ে আসা চান্দের গাড়ি তাঁদের বাড়ির সামনে দিয়েই খাগড়াছড়ি যায়। আরেকটি খবর পেলাম যে চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি বিআরটিসি বাস যায়। ফেনী-করেরহাট-রামগড়-খাগড়াছড়ি হয়ে আরেকটি পথ ছিল।
আমি ঢাকা থেকে হবিগঞ্জে যাই, আম্মার সঙ্গে কয়েকদিন কাটিয়ে নোয়াখালীতে আব্বার সঙ্গে দেখা করে কর্মস্থলে যাবো বলে। হবিগঞ্জ থেকে নানাবাড়ি লাখাই গেলাম, নানাবাড়ির পুকুর পাড়ের চার কোনায় চারটি রেইনট্রি (রেন্ডি কড়ই) গাছ লাগালাম। কারণ এখন আর ঘন ঘন আসা যাবে না, বৃক্ষ থাকুক স্মৃতি হয়ে। নিজেদের বাড়িতেও গেলাম, মুরুব্বীদের কবর জেয়ারত করলাম পারিবারিক কবরস্থানে। এরপর গেলাম আব্বার সঙ্গে দেখা করতে। আব্বার সঙ্গে একদিন থেকে নোয়াখালী থেকে রাতের ট্রেনে উঠলাম চট্টগ্রামের পথে। প্রাপ্যতা অনুযায়ী সে ট্রেনে প্রথম শ্রেণী ছিল না। লাকসাম নামলাম, সেখানে সিলেট থেকে আসা ট্রেনে উঠতে হবে। গভীর রাতে ট্রেন আসলে দেখা গেলো যে ট্রেনের সকল দরজা বন্ধ। ট্রেনও বেশী সময় দাঁড়াবে না, তাই বাধ্য হয়ে সামনে একটা খোলা দরজা পেয়ে উঠে পড়লাম। সে যুগে আমরা হোল্ডঅল/বেডিং নিয়ে চলাফেরা করতাম। উঠে দেখি সেটি অধুনালুপ্ত বিডিআর এর রিজার্ভ কামরা। তারা স্বভাবতঃই আপত্তি করলো। আমি বললাম যে আমি আপনাদের বিরক্ত করছি না, আমার বেডিং এর উপর বসেই আমি যাত্রা শেষ করবো। সকাল ৭ টার দিকে চট্টগ্রাম পৌঁছি। আমার সব সময়ের অভ্যাস সকালে বের হবার আগে কিছু খেয়ে নেয়া, তাই চট্টগ্রাম পুরনো স্টেশন ভবনের দোতলায় রেলওয়ে রিফ্রেশমেন্টে ঢুকলাম। ১৯৮৩ সালেও রেলওয়ে রিফ্রেশমেন্ট যথেষ্ট মানসম্পন্ন ছিল। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে যখন চৈতন্যগলির মুখে বিআরটিসি বাস ডিপোতে গিয়ে পৌঁছালাম তার মাত্র ৫ মিনিট আগে সকাল ৮টায় খাগড়াছড়ি’র বাস ছেড়ে গিয়েছে। কি করা?
হাটহাজারী থেকে চান্দের গাড়ি নাকি করেরহাট-রামগড়? উপস্থিত লোকজনের পরামর্শ করেরহাট-রামগড়। নোয়াখালী থেকে ট্রেনে এসে আবার সোনাপুরের বাসে চেপে বসলাম। যারা জানেন তাঁরা জানেন যে ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে বাস সোনাপুরেই যায়, নোয়াখালীতে না, অন্ততঃ তখন। নোয়াখালী সদর থানার নাম সুধারাম, রেলস্টেশন মাইজদী কোর্ট, মূল রেলস্টেশন সোনাপুর, সব বাসও যেতো সোনাপুরে। চট্টগ্রাম-ঢাকা হাইওয়েতে বারৈয়ারহাট পার হয়ে করেরহাট, সেখানে নেমে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ফেনী-রামগড় মুড়িরটিন বাস আসলে তাতে উঠলাম। বসলাম একদম পেছনে বেঞ্চের মতো সিটে, নাসিরুদ্দিন হোজ্জার মতো পেছন দেখতে দেখতে যাওয়া। পেছনের দরজায় হেল্পারের হাতে বিরাট এক তিনকোনা কাঠ। তখন এর শানেনজুল বুঝিনি। একটু পর যখন বাস গোঁ গোঁ করতে করতে নয়টিলাতে উঠছে তখন হেল্পার ওই কাঠের টুকরা নিয়ে বাসের পেছন পেছন হাঁটছে, বাস উঠতে ব্যর্থ হলে ঠেকা দিতে! আশ্বস্ত হলাম!! হেয়াকো হয়ে এক সময় রামগড়, তখন দুপুরবেলা। রামগড়ও পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি মহকুমা। এসডিও ছিলেন নুর মোহাম্মদ, তিনি একসময় হবিগঞ্জে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন বিধায় আব্বাকে খুব ভালো চিনতেন। রামগড়-খাগড়াছড়ির বাসে চালকের পাশে সিট নিশ্চিত করে গেলাম এসডিও সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। উনি বাসায়, বাসাতেই গেলাম, দেখা হলো। সময় কম থাকায় চা বিস্কিট খেয়ে বাসে চলে আসলাম। বাস ছেড়ে জালিয়াপাড়া-গুইমারা হয়ে ৪টার দিকে পৌঁছালাম মাটিরাঙ্গা। জালিয়াপাড়া একটি চৌরাস্তা, এখানে চট্টগ্রাম থেকে আসা রাস্তা ও মহালছড়ি থেকে আসা রাস্তাও মিলেছে। গুইমারা উপজেলা তখন মাটিরাংগা উপজেলার অধীনে একটি বাজার এবং একটি সেনা ব্যাটালিয়নের সদর। মাটিরাঙ্গা এসে বাস ইঞ্জিন বন্ধ করলো আর ঘোষণা এলো যে আলুটিলায় ধ্বস নামাতে বাস খাগড়াছড়ি যাবে না! আমিতো সাত হাত পানিমে! কি করি? কাছেই উপজেলা অফিস, গেলাম উপজেলা অফিসে। তখন উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাজী ফরিদ আহমেদ, ১৯৭৩ ব্যাচের অন্যতম সেরা অফিসার, পরে লালমনিরহাট, রাজশাহী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসক ছিলেন। গণশিক্ষা কার্যক্রমের সূচনা তাঁর হাতে, লালমনিরহাটে, যা পরে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা পরিদপ্তরের জন্ম দেয়।