পাঠকের কলাম
গর্ভবতী মায়েদের কাছে জনপ্রিয় ছিল ছিকর
লিটন পাঠান, মাধবপুর

শিরোনাম দেখে হয়তো অনেকেই ভাবছেন- ছিকর আবার কোন খাবার? তাও মাটি দিয়ে তৈরী হতো এটা কীভাবে সম্ভব অবাক হওয়ারই কথা। অবাক হলেও কথাটি সত্যি। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ছিকর শব্দটি নতুন মনে হলে প্রবীনদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে মাধবপুর উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চল খ্যাত তেলিয়াপাড়া, সুরমা ১০নং, সাতছড়ি এলাকায় এতিহ্যবাহী ছিকর শিল্প এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। আশি দশকের পূর্বে ওই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি পরিবার পাহাড়ের এটেঁল জাতীয় মাটি দিয়ে এক প্রকার আহার্য্য সামগ্রী তৈরি করে বিক্রি লব্দ অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বিভিন্ন জিনিস পত্রের সাথে ইহা ফেরি করে নগদ টাকা পয়সা ও চাউল দিয়ে বিক্রি করা হত বলে জানা যায়। উলেখ্য ছিকর একটি ফারসি শব্দ। ছিয়া মানে কালো আর কর মানে মাটি। ছিয়াকর শব্দটিই পরে ছিকর হয়ে গেছে। ক্ষুধা নিবারণের জন্য নয়, বরং এক ধরণের অভ্যাসের বশে লোকজন তা খেয়েছে বলে প্রবীণ লোকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে। ছিকর হচ্ছে একধরণের পোড়া মাটি। পাহাড়ি টিলার মাটি দিয়ে বিশেষ এক পদ্ধতিতে আগুনে পুড়িয়ে তৈরি হয় ছিকর। ছিকর বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। কোনটি দেখতে বিস্কুটের মত কোন কোন ছিকর আছে ললিপপের মত লম্বা আবার কোন ছিকর ছোট লজেন্সের মতো। এবার ছিকরের খোঁজে গিয়ে পাওয়া গেল একজন ছিকর শিল্পীকে। তিনি সুরমা ১০নং এর দিনেশ মুন্ডা। তিনি বাপ-দাদার আমল থেকেই ছিকর বানান। দিনেশ মুন্ডা জানান, পূর্বপুরুষরা পাইকারদের চাহিদা মেটাতে পারতেন না। সেটা শত বছর আগের কথা। ছিকরের মাটিকে লোকে ডাকে ছিকনা মাটি। এক ধরনের এঁটেল মাটি। উপজেলার উজান এলাকা সহ পাহাড়ে মেলে এ মাটি। তিনি বলেন, ছিকর তৈরিতে আসলে লাগে দক্ষতা। মাটি শুকানো ও পোড়ানোতেই আসল কারসাজি। ঠিকভাবে না হলে স্বাদ আর ঘ্রাণ কোনোটাই পাওয়া যায় না। ছিকনা মাটি তুলে আনাটাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। টিলায় গর্ত খুঁড়ে লম্বা বাঁশের সাহায্যে গভীর থেকে তুলে আনা হয় এ মাটি। রাতের বেলা মাটিগুলো একটি গামলায় নিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। সারা রাত ভিজে মাটি নরম হলে ছাঁচে ফেলে প্রথমে তৈরি করা হয় মন্ড। তারপর কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করা হয়। এরপর চাকু দিয়ে বিস্কুটের মতো ছোট ছোট করে টুকরা করা হয়। তবে গ্রাহক চাহিদা অনুযায়ী ললিপপ বা লজেন্স আকৃতির ছিকরও হয়ে থাকে। কাটার পর কাঁচা ছিকরগুলো রোদে দেওয়া হয়। দু-এক দিন শুকানোর পর এক ধরনের বিশেষ চুলায় এগুলো পোড়ানো হয়। তারপর একটি মাটির হাঁড়ির নিচের অংশ ভেঙে সেখানে লোহার শিক দিয়ে তৈরি চালুনি বসানো হয়। ছিকরগুলো ওই চালুনির ওপর বসানো হয়। তারপর হাঁড়িটি রাখা হয় একটি মাটির গর্তে। ধানের তুষ দিয়ে আগুন জ্বালানো হয় গর্তে। সতর্কতার সঙ্গে ছিকরের গায়ে শুধু ধোঁয়া লাগানো হয়। দুই ঘণ্টা পর ছিকর কালচে রং ধারণ করে। সুঘ্রাণ তৈরি হয়। গর্ভবতীদের প্রিয় খাদ্য একসময় সিলেট অঞ্চলে, বিশেষ করে হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে ছিকরের প্রচুর চাহিদা ছিল। দোকানেও বিক্রি হতো। হকাররা বাড়ি বাড়িও পৌঁছে দিতেন। নগদ টাকায় বা চালের বিনিময়ে ছিকর কেনাবেচা হতো। গর্ভবতী মায়েদের কাছে জনপ্রিয় ছিল ছিকর। বিশ্বাস করা হতো এটা খেলে রোগবালাই সারে কিন্তু এখন এটিকে অস্বাস্থ্যকর হিসেবেই দেখা হয়। মাধবপুর পশ্চিম বাজারে এখনো ছিকর মেলে। মাধবপুর লোকজ সংস্কৃতি সংগ্রাহক ও গবেষক আক্তার হোসেন এ নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। তিনি বলেন, সিলেট বিভাগের মাধবপুরে একসময়ের জনপ্রিয় খাবার ছিল এটি। শত বছরের পুরনো এই ছিকরশিল্প। এখন অবশ্য বিলুপ্তপ্রায়। মাধবপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছিকর তৈরির কারিগর ছিল। তিনি বলেন- লোকখাদ্যে মাধবপুর উপজেলার মানুষের আলাদা একটি ঐতিহ্য রয়েছে। অতীতে এ খাদ্যের প্রতি মানুষের নিজস্ব একটি স্বকীয়তা ছিল। খাদ্যগুলো হবিগঞ্জ জেলা ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় ত্রিশ শতক থেকে নব্বই শতক পর্যন্ত অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। আক্তার হোসেন এর সংগ্রহ করা তথ্য মতে- কোন এলাকার ছিকরে খাই মাখানোর সময় গোলাপজল, আদার রস ইত্যাদি মেশানো হয়। যা মাটির সাথে পুড়ানোর পর ভিন্ন এক স্বাদের জন্ম দেয়। স্থানীয় কুমার সম্প্রদায় বা মৃৎ শিল্পীদের কেউ কেউ ছিকর তৈরি করে বাজার জাত করতো। উপজেলার হরষপুর উচুঁ টিলা থেকে একসময় বিভিন্ন এলাকার কুমাররা এসে মিহি মাটি সংগ্রহ করত। কিন্তু আজ কাল কেউ আর মাটি সংগ্রহ করতে যায় না। উক্ত টিলা ছাড়াও মাধবপুরের বিভিন্ন জায়গায় ছিকরের উপযোগি মাটি আহরণের ক্ষেত্র আছে। উপজেলার হরিশ্যামা গ্রামের অজিত পাল জানান, ‘মাটিকে ভিজিয়ে নরম করে রুটির মত করে ছোট ছোট টুকরোর মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুধু মাত্র আগুনের ধোয়া দিয়ে পুড়িয়ে তৈরী করা হত। যা এ অঞ্চলের গ্রামগুলোতে ছিকর নামে পরিচিত। ৭০/৮০ দশকে উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারে প্রচুর পরিমাণে এই ছিকর পাওয়া যেত। গর্ভবতী মহিলাদের কাছে ইহা একটি পছন্দনীয় সুস্বাদু খাদ্য ছিল। তাদের ধারণা ছিল এটা খেলে বিভিন্ন রোগ বালাই থেকে বেঁচে থাকা যাবে’। আধুনিক শিক্ষিত মানুষরা ছিকর খাওয়াকে অস্বাস্থ্যকর ও রুচি বিরুদ্ধ বিবেচনা করার কারণে ছিকর এখন বিলুপ্তির পথে।