নব্য জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার ও শাবিপ্রবির ছাত্র নাইমুজ্জামানসহ পাঁচ সদস্য আটক
স্টাফ রিপোর্টার ॥ সিলেটে হযরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে বোমা হামলার পরিকল্পনায় জড়িত সন্দেহে সিলেট থেকে জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির পাঁচ সদস্যকে আটক করেছে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। এই অভিযানের অংশ হিসেবে সিলেটের একটি আবাসিক এলাকা থেকে বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার তাদের আটক করা হয়। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ছাত্র বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশের দাবি, নব্য জেএমবির সিলেট আঞ্চলিক কমান্ডার ও শাবিপ্রবির ছাত্র নাইমুজ্জামানের নেতৃত্বে হযরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট জানায়, গত রোববার রাতে নগরের মিরাবাজারের উদ্দীপন ৫১ নম্বর বাসা থেকে নব্য জেএমবির সিলেট আঞ্চলিক কমান্ডার ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাইমুজ্জামানকে আটক করা হয়।
পরে ঢাকা থেকে আসা পুলিশের বিশেষ একটি দল আজ ভোর পর্যন্ত সিলেট নগর ও নগরের উপকণ্ঠের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে আরো চারজনকে আটক করে। তাদের মধ্যে সাদ ও সায়েম নামের দুজন রয়েছেন। বাকি দুজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সাদ শাবিপ্রবির শিক্ষার্থী এবং সায়েম মদনমোহন কলেজের ছাত্র। তাদের ঢাকায় নেওয়া হয়েছে।
ডিসি মো. ওয়ালিদ হোসেন জানান, সিলেট থেকে যে নব্য জেএমবির পাঁচ সদস্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা পল্টনে বোমা বিস্ফোরণে ঘটনাতেও জড়িত ছিল। তবে জঙ্গি সদস্যদের আটকের ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) জ্যোর্তিময় সরকার।
এদিকে এই অভিযানের অংশ হিসেবে রাত ৯টার পরে সাদের ৪৫/১০ নম্বর শাহজালাল আবাসিক এলাকার বাসায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেই অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আফতাব হোসেন খান। পরে কাউন্সিলর বলেন, ‘সেই বাসা থেকে কাউন্টার টেররিজমের সদস্যরা বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছেন।’
সূত্র জানায়, হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে হামলার পরিকল্পনা ছিল জঙ্গিদের। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি’র পক্ষ থেকে সেই হামলার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিলো। তার আগেই সেই পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছে পুলিশ। হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারকে ঘিরে জঙ্গিদের পরিকল্পনা অনেক দিনের। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০০৪ সালের ২১শে মে মাজার এলাকায় তৎকালীন বৃটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। এর আগে দরগাহের ওরসেও বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছিলো। বিষ ফেলে মাজারস্থ পুকুরের গজার মাছও হত্যা করা হয়েছিলো। সিলেটে অবস্থান করা একটি জঙ্গিগোষ্ঠী পরপর মাজারে হামলা চালিয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, এবারো মাজারে হামলার পরিকল্পনা করেছিলো সিলেটে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠা জঙ্গিরা। আর সেই বিষয়টি জানার পর অভিযান চালানো হয়। গত রোববার ঢাকা থেকে সিলেট আসে পুলিশের একটি টিম। তারা সুনির্দিষ্ট তথ্য নিয়েই সিলেটে এসে অভিযান শুরু করে। প্রথমে তারা অভিযান চালায় নগরীর দক্ষিণ সুরমা এলাকায়। দক্ষিণ সুরমা থানার আওতাধীন এলাকা থেকে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত দুই যুবককে আটক করে। এ সময় দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশের একটি টিমও ঢাকা থেকে আগত পুলিশ কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করেছে। ওই দুই যুবকের মধ্যে একজনকে বাড়ি থেকে অপর জনকে রাস্তা থেকে আটক করা হয়। এরপর পুলিশের একটি টিম অভিযান চালায় নগরীর মীরাবাজার এলাকার উদ্দীপন-৫১ নম্বর বাসায়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রোববার রাত আড়াইটার দিকে পুলিশের একটি টিম উদ্দীপন-৫১ নম্বর বাসায় অভিযানে যায়। এ সময় তারা ৫ তলাবিশিষ্ট ওই বাসা ঘিরে ফেলে। এতে করে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। ওই বাসার মালিক একক কেউ নেই। ফ্ল্যাট কিনে কিনে বাসার মালিক হয়েছেন সবাই। বাসার একটি ফ্ল্যাটে পুলিশ দল ঢুকে প্রায় দুই ঘণ্টা তল্লাশি চালায়। রাত সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তারা অভিযান চালায়। অভিযানের পর তারা এক যুবককে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। তবে ওই যুবককে তারা তাৎক্ষণিক চিনতে পারেননি। কিংবা অভিযানকালে স্থানীয়দের কেউ ওই বাসার কাছাকাছি যায়নি। সোমবার সকাল হওয়ার পর অনেকেই অভিযান সম্পর্কে অবগত হন। ওই বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা যুবক হচ্ছে নাইমুজ্জামান। সে তার পিতা-মাতার সঙ্গেই ওই বাসাতে বসবাস করতো। নাইমুজ্জামানের পিতা ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা ও মা মিরাবাজারের একটি স্কুলের শিক্ষিকা। সে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের ছাত্র। পুলিশ জানায়, নাইমুজ্জামান নব্য জেএমবি’র সিলেটের আঞ্চলিক প্রধান। তার নেতৃত্বেই সিলেটে নব্য জেএমবি নতুন করে সাংগঠনিক কর্মকান্ড শুরু করেছে। অন্তত ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল সিলেটে রয়েছে। তারা গোপনে বৈঠক করতো। এবং প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে তথ্য আদান-প্রদান করতো। গত কয়েক মাসে তাদের গতিবিধির ওপর পুলিশ নজর রাখছিলো। এদিকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, নাইমুজ্জামান তাদের বিভাগের পুরনো ছাত্র। তার সঙ্গের ছাত্ররা ইতিমধ্যে মাস্টার্স শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ইতি ঘটিয়েছেন। কিন্তু নাইমুজ্জামান সবার শেষে অনার্স পাস করে। এর কারণ হিসেবে তারা জানান, ভর্তির সময় বেশ চঞ্চল ছিল নাইমুজ্জামান। সবার সঙ্গে মিশতো। অনার্স তৃতীয় বর্ষে পা দেয়ার পরপরই তার পরিবর্তন শুরু হয়। সে একাকী থাকতো। দু’একজন ছাড়া করো সঙ্গে মিশতো না। ওই সময় সে দাড়িও রাখে। তার আচরণ ছিল রহস্যময়। এরপর অনিয়মিত ছাত্র হওয়ার পর থেকে তার খবর কেউ রাখেনি। বিশ্ববিদ্যালয়েও কম আসতো। নাইমুজ্জামান ছিল অনার্স ২০১৩-১৪ সালের শিক্ষার্থী। সে গত ডিসেম্বরে এসে অনার্স পাস করে। মিরাবাজার এলাকার উদ্দীপন আবাসিক এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, নাইমুজ্জামানের সঙ্গে এলাকার কারো তেমন সুসম্পর্ক ছিল না। সে মসজিদে নামাজ পড়তে যেতো। তবে কারো সঙ্গে মিশতো না। তার পিতাও নামাজি লোক। তিনি সব সময়ই মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেন। এলাকার মানুষের সঙ্গে তাদের তেমন সখ্য নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, অভিযানের পর থেকে তাদের এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন জঙ্গি তাদের এলাকায় অবস্থান করছে সেটি তারা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। এদিকে রোববার রাতে পুলিশের অভিযানে সাদী নামের এক যুবক আটক হয়েছে। সাদীও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা জানায়, সাদী ক্যাম্পাসে বসবাস করতো না। ক্যাম্পাসের বাইরে থেকেই সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করতো। পুলিশের হাতে আটক হওয়া আরেকজন সায়েম। সে মদন মোহন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে পুলিশ জানিয়েছে।