॥ শাহ ফখরুজ্জামান ॥
বর্তমান সমাজে আমরা প্রতিনিয়ত অন্যের সমালোচনায় ব্যস্ত থাকি। কোনকিছু না পাওয়া গেলেও অনুবিক্ষণ যন্ত্র দিয়ে অপরের দুর্বলতা খুঁজে বেড়াই, আর আলোচনার টেবিলে তার বিরুদ্ধে সমালোচনার ঢেউ তুলি। আমাদের ধর্মে এই গীবতের বিরুদ্ধে কঠোরতা প্রদর্শন করার পরও কেউ থেমে নেই। কিন্তু সমাজের এই অসুস্থ সময়েও একজন মানুষ কারও সমালোচনা না করে শুধুই প্রশংসায় ভাসাতেন। তিনি হলেন, আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় মরহুম অ্যাডভোকেট আবুল খায়ের। যে কোন স্থানে যার উপস্থিতি আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করতো। তিনি আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন আমাদেরকে ছেড়ে।
অ্যাডভোকেট আবুল খায়ের সাহেবের সাথে আমার সম্পর্ক এবং চলাফেরা ছিল বহুমাত্রিকভাবে। যে কোন ক্ষেত্র থেকেই যদি তার মূল্যায়ন করতে হয়, তবে কোনটিকে আগে রাখবো সেটা নিয়েই হিমশিম খেতে হয়। কারণ সকল দিকেই তার ভূমিকা ছিল আমার কাছে অতুলনীয়।
লেখার শুরুতেই সদা হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তিটির চরিত্রের যে দিকটি উল্লেখ করার চেষ্টা করছি, সেটি তাঁর শত্রুও অস্বীকার করতে পারবে না। অ্যাডভোকেট আবুল খায়ের এর মূল পরিচয় তিনি আইনজীবী। আইন পেশার প্রতি তার মনোনিবেশ এমন ছিল যে, এই পেশা যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় তার জন্য অন্য কোন কিছুর সাথে জড়াতেন না। সময়মত কোর্টে যাওয়া। সন্ধ্যায় চেম্বার করা। মামলার জন্য নিখুত প্রস্তুতি গ্রহণ। এ ধরনের মনোনিবেশ এখন মফস্বলে খুবই কম দেখা যায়। আইনজীবী হিসাবে তার সবচেয়ে সফলতা; তিনি জুনিয়রদের জন্য ছিলেন আলোর দিশারী। হবিগঞ্জে তিনি যে পরিমাণ জুনিয়রকে অভিভাবকত্ব করেছেন এবং সফল আইনজীবী তৈরি করেছেন তা বিরল। একজন জুনিয়র এই চ্যালেঞ্জিং পেশা থেকে যাতে ছিটকে না যায়, তার জন্য তিনি দিন শেষে জুনিয়রের হাতে প্রণোদনা তুলে দিতেন, কাজের বিবেচনা না করেই।
অ্যাডভোকেট আবুল খায়ের এর সাথে জুনিয়র বা সহযোগী হিসাবে অনেক সিনিয়ররাও কাজ করতেন। হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহিরকে তিনি আপন ভাইয়ের ন্যায় ¯েœহ করতেন এবং সাথে নিয়ে আইন প্র্যাকটিস করতেন। এর আগে সাবেক মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ তার প্রতিবেশী হওয়ায় তাকেও তার সাথে বিভিন্ন মামলায় নিতেন।
সম্প্রতি এ ব্যাপারে আবুল খায়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন “মোস্তফা শহীদ সাহেব আমার চেম্বারে সকাল বেলা এসে বলতেন আজ আমি কোন কোন মামলায় আছি”। রাজনীতিবীদ হিসাবে তিনি ব্যস্ত থাকায় বিভিন্ন মামালায় তাকে সাথে রাখতেন। জেলা আওয়ামী লীগ এর আরেক সাবেক সভাপতি মরহুম শরীফ উদ্দিনও তার সাথে বিভিন্ন মামলায় সাথে থাকতেন। মরহুম আলমগীর ভূইয়া বাবুল ভাই জীবনের শেষ পর্যন্ত তার সাথে থেকেই আইন পেশা চালিয়েছেন। বর্তমানেও তার চেম্বার জুনিয়রে ভরপুর ছিল। তার কোন জুনিয়র যে কোন পর্যায়ে সফল হলে তিনি সবচেয়ে বেশী আনন্দিত হতেন। আর টাকা বেশী দিলেও মোয়াক্কেলরা তার কাছে এসে মানসিক তৃপ্তি পেত বলেই বার বার আসত।
বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট আবু জাহির যাতে ভাল ফলাফল করতে পারেন তার জন্য তিনি দিনরাত প্রচারণা চালাতেন। বিভিন্ন স্থানে টেলিফোনে খোঁজ-খবর নিতেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও অনেক এলাকায় গিয়ে বৈঠক করেছেন। লাখাই উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুশফিউল আলম আজাদের গত নির্বাচনে তিনি লাখাই সড়কের অবস্থা নাজুক হওয়ার পরও চলে যান বিভিন্ন এলাকায়। এই ছিল জুনিয়র এবং ঘনিষ্টজনদের প্রতি তার ভালবাসার নিদর্শন। আর তিনি সবসময় মেলামেশা এবং আড্ডা পছন্দ করতেন। তার চেয়ে বয়সে অনেক কম ঘনিষ্টজনকে তিনি ভাই বলে সম্বোধন করতেন এবং অনেক সম্মান দিতেন। তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আড্ডা দিতেন। অনেক সময় চলে যেতেন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। আর বাসায় গেলেই চা এবং নাস্তা না করিয়ে তিনি কাউকে ফেরত দিতেন না। এই আড্ডার জন্য তিনি আমেরিকা গেলেও দেশে চলে আসতে ব্যকুল হয়ে পড়তেন।
অ্যাডভোকেট আবুল খায়ের ছিলেন হবিগঞ্জ জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার প্রচুর জানাশোনা ছিল। সবসময় বঙ্গবন্ধুর কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করার কথা বললে তিনি বলতেন যত টাকা লাগে দিব কিন্তু ভাল অনুষ্ঠান করতে হবে। এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কি অনুষ্ঠান করা যায়, তার পরামর্শ করার সময় একটি স্মারকগ্রন্থ করার পরামর্শ দিলে তিনি আনন্দিত হন। তিনি বলেন, এই স্মারক গ্রন্থের জন্য নিজে দিবেন ৫০ হাজার টাকা। অন্য টাকারও ব্যবস্থা করবেন। এই স্মারক গ্রন্থের জন্য ৪০টি লেখা সংগ্রহ করি। যার মধ্যে আছেন ড. ফরাস উদ্দিনসহ হবিগঞ্জের কৃতি লেখকরা। পান্ডুলিপি তৈরি থাকলেও করোনা এবং তার শারীরিক অসুস্থতার জন্য আমরা তা প্রকাশ করতে পারিনি। ইনশাআল্লাহ করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই গ্রন্থ প্রকাশ হবে এবং তা আবুল খায়েরকেই উৎসর্গ করা হবে।
অ্যাডভোকেট আবুল খায়ের গুণিজনকে খুবই সম্মান করতেন। তিনি যে কোন পর্যায়ের সফল ব্যাক্তিকে সামনে পেলে অনেক আঁদর সম্মান করতেন। আমার বন্ধু শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল এ বছর রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে স্বর্ণ পদক লাভ করে। বিষয়টি মিডিয়ায় প্রচার হলে তা আবুল খায়েরেরও দৃষ্টি গোচর হয়। তিনি অনেককেই এই সংবাদ দেখান এবং এলাকার ছেলের এই সাফল্যের প্রশংসা করেন। এই সংবাদ প্রকাশের পর আমি শাকিলকে নিয়ে তার বাসায় যাই। তিনি স্বভাবসূলভভাবে কুশল বিনিময়ের পর মেতে উঠেন গল্পে। এ সময় শাকিল তার ডিপার্টমেন্টের চুনারুঘাট বাড়ি এক ছাত্রীর অর্থ কষ্টের কথা জানান। আবুল খায়ের সব শুনে একটি চেক এনে ১০ হাজার টাকা লিখে ওই ছাত্রীর জন্য অধ্যাপক শাকিলের হাতে তুলে দেন। শেষ পর্যায়ে বিদায় নেয়ার সময় শাকিল তার গোল্ড মেডেলের কথা জানাতে গেলে তিনি লাফ দিয়ে উঠে অধ্যাপক শাকিলকে বুকে জড়িয়ে নেন। বলেন, আমি ভূলেই গেছিলাম সেই কথা। শুরু করেন চিৎকার। ঘরে কি আছে নিয়ে আসো। ড্রয়িং রুম থেকে ভিতরে চলে যান। তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন কিছু আছে কিনা। কিছু নাই জানালে তিনি ভিতরে খুজে পান, বাড়ি থেকে আসা দুই বোতল লালি গুড় আর ব্যাংক থেকে দেয়া দু’টি ক্যালেন্ডার। তিনি সেগুলো নিয়ে এসে আমাকে ও শাকিলকে এক বোতল করে লালিগুড় এবং ক্যালেন্ডার দেন। শাকিল এই উপহার পেয়ে যার পর নাই আনন্দিত হয়। সে মন্তব্য করে গোল্ড মেডেল পাওয়ার জন্য তিনি মিস্টি খাওয়াতে না পেরে ঘর থেকে লালিগুড় এনে দিয়েছেন। এই ভালবাসার উপহার নিঃসন্দেহে অমূল্য। এটিই ছিল তার কাছ থেকে পাওয়া আমাদের জীবনের শেষ উপহার।
অ্যাডভোকেট আবুল খায়ের ছিলেন একজন সংবাদপত্র সেবী ও সাংবাদিকের বন্ধু। নব্বইয়ের দশকে তিনি সাপ্তাহিক স্বদেশ বার্তাকে পৃষ্টপোষকতা করেছেন। জীবনের শেষ সময়েই ছিলেন দৈনিক দেশজমিনের সাথে জড়িত। সাংবাদিকরা যে কোন কাজে আসলে তিনি খুশি হতেন এবং সহযোগিতা করতেন। সাংবাদিকরাও তাকে সম্মান করতেন। তিনি অসুস্থ অবস্থায়ও সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে স্থানীয় পত্রিকায় কলাম এবং মন্তব্য প্রতিবেদন লিখতেন। বাসায় সব স্থানীয় পত্রিকার পাশাপাশি ৩/৪টি জাতীয় পত্রিকা রাখতেন। সংবাদপত্রের মাধ্যমে ভাল কাজকে অভিনন্দন জানাতেন। আর কোন দুঃখজনক ঘটনায় শোক প্রকাশ করতেন। পত্রিকায় তার কোন লেখা বা নিউজে তার বক্তব্য আসলে খুবই খুশি হতেন। নিদেন পক্ষে তার নামটি সংবাদপত্রে দেখলেই তিনি খুশিতে আত্মহারা হতেন। কিন্তু আজ তাকে নিয়েই এই লেখা তার চোখে পড়বে না। তিনি চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে। তবে তার কর্মের কারনেই তিনি আমাদের হৃদয়ে থাকবেন চির ভাস্কর হয়ে।
লেখক :
আইনজীবী ও সাংবাদিক