স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় ‘হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসীকে দেখার জন্য জনগণের লাইন লেগে গেছে’- এমন একটি খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে। অসংখ্য মানুষ এমন একটি সংবাদ ফেসবুকে শেয়ার করে দর্শণার্থীদের কান্ডজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কেউ কেউ রসিকতাও করছেন। আবার কেউ কেউ এমন প্রশ্নও তুলেছেন, তাহলে স্থানীয় প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিরা কী করছেন?
বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার এই দুদিন ধরে সিলেট বিভাগের কিছু ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে এই খবরটি বেশি বেশি শেয়ার হয়েছে। এক পর্যায়ে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী, জনপ্রতিনিধি এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরেও আসে বিষয়টি। তারা ঘটনার তদন্ত শুরু করেন।
তদন্তে দেখা যায়, সেখানে কোনো প্রবাসী ব্যক্তি হোম কোয়ারেন্টিনে নেই। তাকে দেখার জন্যও কেউ সেখানে যায়নি। একটি ভিন্ন ঘটনাকে রঙ মেখে, গুজব ছড়িয়ে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বলে ভাইরাল করা হয়েছে।
যা ভাইরাল হয়েছে: দেশের একজন জনপ্রিয় ব্লগার আজ শুক্রবার নিজের ফেসবুক পেইজ থেকে ভাইরাল হওয়া সচিত্র এই সংবাদটি শেয়ার দিয়েছেন। সংবাদটি হচ্ছে- ‘নবীগঞ্জে এক প্রবাসীকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। সেই প্রবাসীকে দেখতে এলাকার মানুষ এভাবেই প্রতিদিন ভিড় করছে বাড়ির গেইটে।’
তারপর ব্লগার নিজের মতামত ব্যক্ত করে লিখেছেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে হয়তো এখানে মেলা বসে যাবে। কে জানে হয়তো ১০ টাকা করে টিকিট চালুও করে দিতে পারে প্রবাসীর পরিবার।’
প্রকৃত ঘটনাটি কী: নবীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আলহাজ্ব ছাবির আহমেদ চৌধুরী শুক্রবার বিকেলে জানান, এই ঘটনায় সারাদেশ থেকেই তিনি ফোন পাচ্ছেন। অসংখ্য গণমাধ্যমকর্মী এ ব্যাপারে তার কাছ থেকে জানতে চাচ্ছেন। কিন্তু যে সংবাদটি ভাইরাল হয়েছে এর সঙ্গে করোনা ভাইরাসের কোনো সম্পর্ক নেই। সেখানে যা ঘটেছে তা আসলে একটি পারিবারিক ঘটনা। সেটিই ভুলভাবে উপস্থাপন করে ফেসবুকে ভাইরাল করা হয়েছে।
মেয়র ছাবির আহমেদ চৌধুরী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, নবীগঞ্জ পৌরসভার গয়াহরি এলাকার বাসিন্দা ধীরেন্দ্র চন্দ্র দেবের ছেলে ধনঞ্জয় চন্দ্র দেব প্রায় ১০ বছর ধরে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। এক বছর আগে দিনি হবিগঞ্জ আধুনিক হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক রথীন্দ্র চন্দ্র দেবের মেয়ে অনুশ্রীতা দেব অনুকে বিয়ে করেন।
বিয়ের পর নবদম্পতি অস্ট্রেলিয়া চলে যান। গত বুধবার স্বামী-স্ত্রী দুজনই দেশে ফিরে আসেন। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মেয়ে ও জামাইকে আনতে যান রথীন্দ্র চন্দ্র দেব। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে মেয়ে অনু বাবার কাছাকাছি এলেও ধনঞ্জয় কিছুটা আড়ালেই ছিলেন।
ধনঞ্জয় শ^শুরকে দূর থেকে বলে দেন, ‘আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে চলে যান। আমার পক্ষে আর আপনার মেয়ের সঙ্গে সংসার করা সম্ভব না। আপনারা চলে যান।’
রথীন্দ্র চন্দ্র দেব মেয়েকে নিয়ে হবিগঞ্জের নিজের বাসায় চলে আসেন। পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরে অনুশ্রীতা দেব অনু তার মাকে নিয়ে শ^শুরবাড়ি গয়াহরিতে হাজির হন। অনু সেখানে গিয়ে দেখেন বাড়ির দরজা বন্ধ, তাছাড়া স্বামী ধনঞ্জয়ও সেই বাড়িতে নেই। অনেক ডাকাডাকির পর শ^শুর ধীরেন্দ্র চন্দ্র দেব এগিয়ে আসেন।
ধীরেন্দ্র পুত্রবধূকে বলে দেন, তিনি গেইট খুলবেন না। ছেলেও এই বাড়িতে আসেনি।
কিন্তু পুত্রবধূ অনুশ্রীতা দেব গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন, ‘এটা আমার শ^শুরবাড়ি, স্বামীর বাড়ি আমি এখানেই থাকবো।’
‘দুজন মেয়ে গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে। আশপাশের অনেকে তো তাদের চিনেও। আবার এই চিল্লাচিল্লি দেখে সেখানে কিছু লোকজনও জড়ো হয়ে যায়। এক পর্যায়ে বিষয়টি নবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কানে আসে। তারপর নয় নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও শুনতে পান। তারপর আমি শুনি’, বলেন মেয়র ছাবির আহমেদ চৌধুরী।
মেয়র আরো বলেন, ‘ঘটনাটি যেহেতু পারিবারিক সেহেতু তখন আমরা দুই পরিবারের অভিভাবকদের নিয়ে স্থানীয় ডক্টর ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বসি এবং সেখানে স্বামী-স্ত্রী তাদের কেউ ছিলেন না। পরে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, যেহেতু তারা বিদেশ থেকে এসেছেন, তাই তারা প্রথমে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকবেন, তারপর বিষয়টি নিয়ে সালিশ করা যাবে’।
‘এই যে মেয়েটিকে নিয়ে এই ঝামেলা হলো, লোকজন জড়ো হলো- এটাকেই ভাইরাল করা হয়েছে। বলা হচ্ছে কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসীকে দেখতে মানুষের ঢল নেমেছে। আসলে বিষয়টি এমন নয়- এটা মিথ্যা’, যোগ করেন মেয়র ছাবির আহমেদ চৌধুরী।
ঘটনাটি শোনার পর শুক্রবার দুপুরে ঘটনাস্থলে যান নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ^জিৎ কুমার পাল। পরে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি শুনেছিলাম এখানে একজন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এসেছেন। তিনি হোম কোয়ারেন্টিনে কীভাবে থাকবেন সেটি জানানোর জন্য আমি এসেছিলাম। কিন্তু তার পিতা বললেন, তিনি এখানে আসেননি। তার এক আত্মীয়ের বাসায় আছে। আমি তার বাবাকে বলে গেলাম, ছেলে যদি বাড়িতে আসে, তাহলে দেশে প্রবেশের পর থেকে ১৪ দিন ধরে তাকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। সরকারি নির্দেশ তাকে মানতে হবে।’
ইউএনও যাওয়ার সময়ও ধনঞ্জয় দেবের বাড়ির গেইট বন্ধ ছিল। তিনিও গেইটের সামনে থেকে ফিরে আসেন।