পাঠকের কলাম

জসিম উদ্দিন
আলজেরিয়ার ছোট্ট একটি শহর ওরাও। সুখে-শান্তিতেই বসবাস করছিলেন সেই শহরের মানুষ। হঠাৎ একদিন শহরে ইঁদুরের উৎপাত শুরু হলো। ইঁদুরের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষও ইঁদুর মারতে শুরু করলেন। প্রথমে মানুষ মরা ইঁদুরগুলোকে ময়লা-আবর্জনার স্তুপে ফেলতে লাগলেন। একপর্যায়ে ইঁদুর মরা বাড়তে লাগলো। মানুষ তখন মরে যাওয়া ইঁদুরগুলোকে মাটিতে পুঁতে ফেলতে শুরু করলেন। একসময় শহরের সব ইঁদুর মারা গেলো। কিন্তু ইঁদুর থেকে পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়লো এক মহামারী।
আলবেয়ার কামু’র বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’ এর কেন্দ্রীয় চরিত্র মধ্যবয়সী ডা. রিও। হঠাৎ একদিন প্রচন্ড জ্বরে তার এক প্রতিবেশি মারা যান। ডা. রিও গবেষণা করে বের করলেন যে তার প্রতিবেশি এক অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। কিন্তু শহর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করলেন। তাদের দাবি ওই ব্যক্তি স্বাভাবিক জ্বরে মারা গেছেন। শুরুতে কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে শহরবাসীর চাপে স্বীকার করে নেয় যে ‘প্লেগ’ নামক এক মহামারীতে মানুষ মারা যাচ্ছে। আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়লেন শহরের মানুষ। একসময় পুরো শহরের সমস্ত মানুষকে বন্দী করে রাখা হল। যেটাকে এখন আমরা ‘কোয়ারেন্টিন’ হিসেবে জানি। এই শহরের মানুষ বাহিরে বের হতে পারবেন না। আবার বাহিরের মানুষও এই শহরে ঢুকতে পারবেন না।
প্লেগ বিধ্বস্ত শহরে এক মহামানব হয়ে আবির্ভূত হন উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র রিও। মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে দিনরাত পরিশ্রম করে মানুষের চিকিৎসা করতে লাগলেন রিও। একসময় তার স্ত্রী মারা যান প্লেগ রোগে। কিন্তু চোখের সামনে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু তাকে অনুভূতিহীন করে তুলে। তাইতো তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর মৃত্যুও তার কাছে একেবারেই তুচ্ছ মনে হয়। স্ত্রীর মৃত্যুতে কোনো প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করেননি ডা. রিও।
ওরাও শহরের প্রধান গির্জার পুরোহিত ফাদার প্যানালু প্লেগকে ঘিরে তার ধর্মীয় চিন্তাকে ছড়িয়ে দিতে থাকেন, আর এর ফলে শীতল যুদ্ধে জড়ান ডাক্তার রিও’র সাথে। ফাদারের মতে, প্লেগ ঈশ্বরের অভিশাপ। শুরু হয় বিজ্ঞান আর ধর্মের দ্বন্দ্ব। একসময় ফাদার প্যানালুর প্রস্থান হয় প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে। ঈশ্বরের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাননি স্বয়ং ফাদার প্যানালুও!
যাই হোক, অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে একসময় প্লেগ এর প্রাদুর্ভাব থেকে মুক্তি পান ওরাও শহরের মানুষ। শহরের মানুষ তখন উল্লাস করতে থাকে। সবার মধ্যে আনন্দ আর কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসে। ১৯৪৭ সালে লিখিত বিখ্যাত ফরাসি লেখক ও উপন্যাসিক আলবেয়ার কামুর ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসের পটভূমি ও বিভিন্ন ঘটনার একটা অংশ তুলে ধরা হল এতক্ষণ।
এবার আসি করোনা ভাইরাস প্রসঙ্গে। চীনের উহানের সেই চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াংয়ের মত ডা. রিও মারা গিয়েছিলেন সেই মহামারীতে। মৃত্যুঝুঁকিকে তুচ্ছ মনে করে ‘একদল রিও’ (বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক) ইতিমধ্যে চীন থেকে করোনা বিধ্বস্ত ইতালীতে পৌঁছে গেছেন আক্রান্তদের সেবা দিতে। ইতিমধ্যে ইতালীতে করোনার কবলে পড়ে একজন রিও’র প্রস্থানও হয়েছে! যুগে যুগে ইতিহাসের পাতায় নানা ঘটনার কী অদ্ভুত মিল!
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে যখন প্রথম করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে তখন সেটা চীনেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু কিছুদিন পরেই চীন থেকে খুব দ্রুত সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পরে মরণঘাতক করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। ইতালীসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন থেকে করোনা ভাইরাসের কথা মহামারী হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন থেকেই বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলে আসছে, তাদের নাকি সব প্রস্তুতি আছে। বিশেষ করে প্রথম থেকেই দাবি করে আসছিল যে, তাদের নতুন এই করোনা ভাইরাস সনাক্তের সক্ষমতা আছে। এমনকি এয়ারপোর্টে নাকি তিনটি করোনা ভাইরাস সনাক্তকরণ মেশিনও রাখা হয়েছে। তিনটি মেশিন থাকা স্বত্বেও ইতালীফেরত বাংলাদেশী প্রবাসীর শরীরে করোনা ভাইরাস ধরা পরেনি কেন সেই প্রশ্ন এখনও সবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
আমাদের শহরেও ডা. রিও বা ডা. ওয়েনলিয়াংয়ের মত ডাক্তার রয়েছেন। আইইডিসিআর বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যখন বলছে আমাদের সব প্রস্তুতি রয়েছে তখন আমাদের রিওরা সামনে এগিয়ে আসার সাহস পাবেন কি করে! বৈঠক হচ্ছে আমলাদের নিয়ে, প্রশাসকদের নিয়ে। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ নেয়া হচ্ছে না।
আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা টিভিতে শুধু ব্রিফিং দিচ্ছেন আর তথ্য দিয়েই দিচ্ছেন। করোনা মোকাবেলায় আমাদের রিওদের (বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক) নিয়ে আইইডিসিআর বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখনো কোনো বৈঠকে বসেননি। যা আমাদের হতাশ করে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি বিশেষ অনুরোধ, এখনও সময় আছে। করোনা মোকাবেলায় আমদের রিও বা ওয়েনলিয়াংদের নিয়ে বসুন। ফল পাবেন। তা না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
শেষ করছি কামুর উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’ এর শেষ দৃশ্য দিয়ে “দূর শহর থেকে ভেসে আসা তুমুল হর্ষধ্বনি শুনতে শুনতে মনে হল, মানুষের এই উল্লাস হয়তো আবার একদিন বিপন্ন হবে, কারণ প্লেগের জীবাণু কখনোই পুরোপুরি ধ্বংস হয় না, হারিয়েও যায় না চিরতরে। বছরের-পর-বছর এই জীবাণু লুকিয়ে থাকে আসবাবপত্র আর কাপড়চোপড়ের মধ্যে, অপেক্ষা করে শোবার ঘরে, ভাঁড়ারে, বুকশেলফে। তারপর সেই দিনটি আসে যেদিন এই জীবাণু মানুষের সর্বনাশের জন্য আবার ইঁদুরগুলোকে জাগিয়ে উত্তেজিত করে মরবার জন্য, এবং ঝাঁকে ঝাঁকে ওদেরকে পাঠিয়ে দেয় আনন্দমুখর কোনো শহরে।”

জসিম উদ্দিন
প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ
বানিয়াচং আইডিয়েল কলেজ, বানিয়াচং, হবিগঞ্জ। ০১৭১৭৭৯৩৯৮৮