ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
আমি জন্ডিসের চিকিৎসার আরো একটা পদ্ধতি দেখেছি। ছোট্ট এক ধরনের গাছের ডাল কুচিকুচি করে কেটে বিশেষ এক পদ্ধতিতে সুতা প্রবেশ করিয়ে ছোট একটা মালা তৈরি করে মাথার তালুতে রাখা হত। ধীরে ধীরে ডালগুলো শুকোতে থাকলে সুতা ঢিল হত এবং মালা বড় হয়ে পুরো শরীর বেয়ে বেয়ে পা দিয়ে নেমে যেত। তার মানে জন্ডিস ভাল হয়ে যাবে এতে কোনই সন্দেহ নেই।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের এত অগ্রগতির পরও অদ্যাবধি আমরা কুসংস্কারমুক্ত হতে পারিনি। কখনো আমার জন্ডিস হয়েছে এমনটা মনে নেই, তবে ছোট সময়ে এর অনেক চিকিৎসা পদ্ধতি দেখেছি। শুধু তাই নয় আমার পঁয়ত্রিশ বছর প্র্যাকটিসকালীন সময়েও এসকল অপচিকিৎসার কম সম্মুখিন হইনি। মূলত জন্ডিসের আসল কারণ ভাইরাস। অন্য কোন কারণ থাকলেও সংখ্যায় নগণ্য। লিভার থেকে নির্গত পিত্তরসের বিলিরুবিন রক্তে বেড়ে গিয়ে সমস্ত শরীর হলদে হয়ে যায়। অথচ ঝাঁড়ফুক দিয়ে হাতের তালুর ভিতর থেকে হলুদ রঙ্গের গুড়া কবিরাজরা বের করে দেদারসে পয়সা কামাচ্ছে। রোগের তেমন লাভ ক্ষতি না হলেও কিছুটা মানসিক প্রশান্তি হচ্ছে তা ঠিক। ভাটি অঞ্চলে মাথার তালুর চুল গোল করে কামিয়ে কাইক্কা মাছের দাঁতযুক্ত ঠোট দিয়ে বিশেষ কায়দায় আঘাতপ্রাপ্ত করে বিশেষ এক ধরনের পাতা বেটে বরন দেয়া হত যা শক্ত হয়ে মাথায় প্রায় তিন সপ্তাহ লেগে থাকত। ইত্যবসরে ভাইরাস আক্রান্ত জন্ডিস কমে যেত, ফলে সুখ্যাতিটা বরনদাতা কবিরাজ পেয়ে যেতেন। আমি জন্ডিসের চিকিৎসার আরো একটা পদ্ধতি দেখেছি। ছোট্ট এক ধরনের গাছের ডাল কুচিকুচি করে কেটে বিশেষ এক পদ্ধতিতে সুতা প্রবেশ করিয়ে ছোট একটা মালা তৈরি করে মাথার তালুতে রাখা হত। ধীরে ধীরে ডালগুলো শুকোতে থাকলে সুতা ঢিল হত এবং মালা বড় হয়ে পুরো শরীর বেয়ে বেয়ে পা দিয়ে নেমে যেত। তার মানে জন্ডিস ভাল হয়ে যাবে এতে কোনই সন্দেহ নেই। তাছাড়াও বোতলজাতকৃত বিভিন্ন কবিরাজের ঔষধ বিভিন্ন এলাকায় বেশ সুনামের সহিত জন্ডিসের মহৌষধ হিসাবে বিক্রি হচ্ছে যার কোন গবেষণা বা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নেই। বরং কাঁচা পাতার রস আনুবিক্ষণিক পর্যায়ে যকৃত বা লিভারের ক্ষতি সাধন করছে ভাইরাস আক্রান্ত লিভার কোষে।
আমরা যখন ছোট তখন ভাটি অঞ্চলে শুকনার মৌসুমে বেদেরা দল বেঁধে নৌকার বহর নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত। খালের সাথে সংযুক্ত প্রতিটি গ্রামের একটা নিরাপদ স্থানে ওরা আস্তানা গাড়ত। এদের চালচলন, হাটার ভঙ্গি, কথা বলার ধরণ একটু ভিন্ন প্রকৃতির। বলা চলে হিজরাদের সাথে অনেকটাই মিল আছে। কোমড়ে রুপার চ্যাপ্টা বিছা, গলায় হার, হাতে মোটা বালা, কপালে টিপ, মাথার তালুতে খোঁপা বেঁধে ফুল গুঁজে দেয়া ছিল লক্ষণীয়। আমরা মাঝে মাঝে এদের নৌকার কাছে গিয়ে ব্যতিক্রম ধর্মী চালচলন, বাচ্চাদের দুষ্টুমি, রান্নাবান্না নিরীক্ষণ করতাম। দাদি এদের কাছে যেতে বারণ করতেন। ভয় হল যদি ধরে নিয়ে চলে যায়, দ্বিতীয়ত যুবতি মেয়েদের অঙ্গভঙ্গিকে রক্ষণশীল গ্রামবাসীর নিকট কিছুটা অশালীন মনে হত।
বেদে পুরুষরা সাধারণত কাজ করেনা, বাচ্চাদের ও সংসার দেখাশোনা করে। মেয়রা পুরুষদের পছন্দ করে বিয়ে করে। তাদের বাহিরের লোককে বিয়ে করতে আপত্তি নেই তবে এদের সাথে মিশে যেতে হবে। নারী ও যুবতীরা গোত্র ভেদে সাপ খেলা দেখানো, ঝাড়ফুঁক ও কবিরাজি, শিঙ্গা লাগানো ( কাপিং থেরাপি), যাদু দেখানো এসব করে থাকে।
বাড়ি বাড়ি ঘুরে সাপ খেলা দেখানোর সময় গাল ফুলিয়ে সাপের বাঁশি বা বীণ বাজিয়ে সাপ নাচায়।
‘খা খা খা, বখ্খিলারে (বখিল বা কৃপণ) খা, যার বাইরে সরল ভিতরে গরল তারে ধইরা খা’ সুর ধরে এসব গান গাইত। বেহুলা লখীন্দরের করুণ কাহিনি শোনাত গানে গানে।
গরুর শিং দিয়ে শিঙ্গা লাগিয়ে মুখ দিয়ে টেনে লালা মিশ্রিত রক্ত বের করে বাতের চিকিৎসা করত। পরিশেষে চাহিদা মতো পারিশ্রমিক না দিলে চিল্লাপাল্লা করে অভিশাপ দিত। অবশ্য এটা হল এদের একটা কৌশল, গ্রামের সহজ সরল মানুষদের কাবু করার সুপরিকল্পিত অভিনয়ও বলা চলে।
তারপরও বেঁচে থাকার কুটকৌশলে কিছুটা ছলচাতুরীর আশ্রয় মানুষ নিলেও এর ভিতরে বাস করে যেন অন্যরকম এক অনুভূতি। ক্ষিদের কারণে চুরি করলেও সিঁদেল চোর চুরি করে বাড়ি ফেরার সময় ছোট্ট বাচ্চাটির জন্য সামান্য জিলাপি বা কয়েকটি চকলেট হাতে নিয়ে ফিরে। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে দশ টাকার বাদাম দৌড়ে এগিয়ে আসা শিশটির হাতে দিলে মুখে যে স্বর্গীয় হাসিটা ফুটে উঠে এর তুলনা পৃথিবীতে অন্য কিছু দিয়ে হয় না। তেমনি বেঁদেদের মাঝেও বেলা শেষে এমনতর প্রাণোচ্ছল অনুভূতির বিকিরণ আমার নজরে পড়েছে।
আমি সমাজের প্রায় সকল স্তরের সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে চেষ্টা করেছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে গ্রামের সাধারণ মানুষ থেকে সম্ভ্রান্তজন, শুদ্র থেকে কুলীন, এমনকি ভিক্ষুক, হিজরা, ডাকাত, সন্ত্রাসী সকল পর্যায়ের লোকজনদের সান্নিধ্যে আসতে হয়েছে নিবিড়ভাবে। উপর-নীচ উভয় স্তরে আবেগ অনিভূতির ব্যবধান সুক্ষভাবে বিশ্লেষণের সুযোগ পেয়েছি। এদের মাঝে অসুখ-বিসুখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-ভালবাসা নিরীক্ষণ করতে পেরেছি। এমনকি তাদের কাছ থেকে অনেক মানবিক গুণাবলী আয়ত্ব করে তা নিজের জীবনধারায় কিছুটা হলেও সংযোজন করতে পেরেছি। আসলেই প্রকৃত সুখ ধনে নয় মনে, অট্টালিকায় নয় কুঁড়ে, প্রাচুর্যে নয় প্রাপ্তির সন্তুষ্টিতে বুঝতে পেরেছি।
একথা ভাবারও সুযোগ পেয়েছি…

‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর,
মানুষের মাঝে স্বগ-নরক মানুষেতে সুরাসুর।
রিপুর তাড়নে যখন মোদের বিবেক পায়গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক অনলে তখনই পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়ে ঘরে।’