দেশে সারের যে সংকট দেখা তার ধাক্কা হবিগঞ্জেও লেগেছিল
বিভাগীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হবিগঞ্জ সর্বোচ্চ পদক জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়
আতাউর রহমান কানন
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৮, সোমবার। আজ জেলার দুগর্ম উপজেলা বলে খ্যাত আজমিরীগঞ্জে ট্যুর নির্ধারিত রয়েছে। এ উপজেলায় এর আগে যতবার গিয়েছি সবই বর্ষাকালে স্পিডবোটে। শুকনো মৌসুমে গাড়ি নিয়ে ভ্রমণের তেমন ভালো কোনো পথ নেই। তবে ইদানীং বানিয়াচং হয়ে পানিশূন্য হাওড়ের বুক মাড়িয়ে আঁকাবাঁকা কাঁচা পথে জীপ গাড়িতে যাওয়া যায়। তবে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এই সুযোগ থাকে। খোঁজখবর নিয়ে তাই এই কাঁচা পথে ভ্রমণের মনস্থির করেছি।
সকাল আটটায় স্টাফ অফিসারকে সঙ্গী করে আজমিরীগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করি। আকাশটা বেশ পরিষ্কার। ফাল্গুনের ফুরফুরে বসন্ত হাওয়া বইছে। বানিয়াচং উপজেলা সদর পর্যন্ত পাকা রাস্তা। এরপর শুরু হয় আঁকাবাঁকা এবরোথেবরো কাঁচা পথ। গাড়ি চলছে, ধুলোবালি উড়ছে। আর ঝাঁকুনির চোটে নাড়িভুঁড়ি পাক খেয়ে টনটনিয়ে উঠছে। পথের দুপাশে বিস্তীর্ণ হাওড়জুড়ে শুধু সবুজ ধানের খেত। আশেপাশে কোনো লোকালয় নেই বললেই চলে। দূরে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত টিলার মতো বসতি দৃষ্টিগোচর হয়। প্রায় নির্জন এ পথে একাকী ভ্রমণ করা কারো পক্ষে অসম্ভব ব্যাপারও বটে। তবে বাংলার সৌন্দর্য্যপিপাসুদের ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা।
আমাদের গাড়ি দেড়ঘণ্টা ভ্রমণের পর সকাল ১০টায় আজমিরীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে এসে থামল। আমি ফ্রেশ হয়ে আধঘণ্টা পর পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী কাজে নামলাম। প্রথমে উপজেলা পরিষদের সভাকক্ষে উপজেলার সকল কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যানদের সমন্বয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় যোগদান করি। ইউএনও হামিদুল হক সভাটি পরিচালনা করেন। উপজেলার সুবিধা-অসুবিধাসমূহ সভায় তুলে ধরা হয়। এরপর সেখান থেকে বেরিয়ে যথাক্রমে থানা, পৌরসভা, উপজেলা ভূমি অফিস, তহসিল অফিস ইত্যাদি পরিদর্শন করি। অতঃপর আজমিরীগঞ্জ এবিসি হাইস্কুল দর্শন করি। স্কুলটি ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত। মফস্সলের এই স্কুলটির পড়ালেখার ফলাফল বেশ ভালো জানলাম। আমি নিজেও অষ্টম-নবম-দশম শ্রেণিতে ঢুকে শিক্ষার্থীদের পড়ার মান যাচাই করলাম। তাতে খারাপ মনে হয়নি। পরিদর্শন বইতে মন্তব্যসহ একটি নোট লিখি।
ইউএনওর বাসায় লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিল। ইউএনও কীভাবে যেন জেনেছিল আমি মাছের ভক্ত। তাই হাওড়ের মাছ আর বাদ রাখেনি। বিভিন্ন জাতের টাটকা মাছের সে কি সমাহার! হাওড় এলাকার নির্মল সুপরিবেশে খিদেও পেয়েছিল বেশ। আমি পেটুকের মতোই মাছভাত খেয়ে ইউএনওর পরিশ্রম যথাসাধ্য সার্থক করার চেষ্টা করি। আজমিরীগঞ্জ থেকে বিকেলের সোনালি মিঠে রোদ গায়ে মেখে বিদায় নিই। সন্ধে ৬টায় নিজ বাসায় ফিরে আসি।
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৮, বুধবার। সকাল ৯টায় অফিসে যাই। আজ বাহুবল উপজেলায় ভ্রমণে যাওয়ার প্রোগ্রাম পূর্বনির্ধারিত। অফিসের কিছু জরুরি কাজ ও দর্শনার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ সেরে বাহুবলের উদ্দেশে বের হই। ১১টায় ইউএনও অফিসে পৌঁছি। সেখানে বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় মিলিত হই। এ সভা শেষে ইউএনওসহ সাতকাপন ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে যাই। সেখানের চেয়ারম্যান একটি ছোটখাট সমাবেশের আয়োজন করেন। আমি সে সমাবেশে বক্তব্য রেখে ইউপি কার্যালয়ের কাজকর্ম পর্যালোচনা করি। এরপর সেখান থেকে ১২টায় বাহুবল থানা দর্শনে যাই। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী থানায় পৌঁছে দেখি ডিউটি অফিসার ও একজন এএসআই ছাড়া আর কেউ নেই। জিজ্ঞাসাবাদে জানলাম ওসি অন্যান্য ফোর্স নিয়ে নাকি আসামি ধরতে গেছেন। বিষয়টি আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পিআরবি ও সরকারি নির্দেশনামতে এ মাসে তিনটি থানায় পরিদর্শন-দর্শনে গিয়ে এরকম অবস্থা দেখি। পুলিশ কর্তৃপক্ষ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে যে এড়িয়ে চলছে, সেটা এখন এদেশের নাবালকও বুঝে। বিচারবিভাগ স্বাধীন হওয়ার পর এরাও স্বাধীনতা চান। নির্বাহী বিভাগের এই বিভাগ স্বাধীন হয়ে গেলে দেশ চলবে কীভাবে- সেটা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। আর তাঁদের স্বাধীনতার জন্য তাঁদের পেশকৃত দাবি অনুযায়ী ‘পুলিশ কমিশন’ গঠনে সরকার অনুমোদন না দেওয়ায় তাঁরা যে ক্ষুব্ধ সেটার বহিঃপ্রকাশ পদে পদে ঘটছে। এসব বিষয় আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মাঠ প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে। তাঁরা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না। শুধু বলছেন, অপেক্ষা কর, সময়ই সব সমাধান দিবে।
আমি থানা থেকে বের হয়ে জেমস্ ফিনলে কোম্পানির রশিদপুর চা বাগানে যাই। বাগানের ম্যানেজার বশির আহমেদ আমার পূর্বপরিচিত ও ঘনিষ্ঠজন। আজ সেখানে আমার দাওয়াত ছিল। আমি সে দাওয়াত রক্ষা করে বিকেলে বাসায় ফিরে আসি।
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৮, বৃহস্পতিবার। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অফিসেই ছিলাম। লাঞ্চের পর বানিয়াচং উপজেলার সুবিদপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে যাই। সেখানে শ্রমিক নেতা ও সমাজসেবী ইউপি চেয়ারম্যান সজিব আলীর উদ্যোগে চক্ষু চিকিৎসা ও পরিচর্যা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এখানে বিনামূল্যে চক্ষু পরীক্ষা করা হবে। আর নামমাত্র মূল্যে চোখের ছানি, নালি ও ফরেন বডি টেরিজিয়াম অপারেশন করা হবে। আজ কেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা উপলক্ষ্যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সিভিল সার্জন ডা. মোশাররফ হোসেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরে আলম সিদ্দিকী, জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ এম ইয়াহিয়া, শচীন্দ্র কলেজের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর শচীন্দ্র লাল সরকার-সহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি অতিথি হিসেবে যোগদান করেন এবং তাঁদের বক্তব্যে চেয়ারম্যানের এই মহতী উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানো হয়। আমিও চেয়ারম্যান সজিব আলীর প্রশংসা না করে পারলাম না। বক্তৃতার পালা শেষে কেন্দ্রটির উদ্বোধন করে সন্ধ্যার আগে হবিগঞ্জ সদরে ফিরে আসি।
১ মার্চ ২০০৮, শনিবার। আজ সিলেট স্টেডিয়ামে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের সন্তানদের সমন্বয়ে বিভাগীয় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। সকাল সাড়ে ৭টায় হবিগঞ্জের টিম নিয়ে রওনা করে ৯টায় সিলেট স্টেডিয়ামে পৌঁছি। ঘড়ি ধরে ১০টায় বিভাগীয় কমিশনার যথাযথ আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে খেলা উদ্বোধন করেন। এরপর খেলার এক পর্যায়ে সুনামগঞ্জের ডিসি সাবের হোসেন ও আমি জাফলং যাই। ১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে সর্বশেষ বার আমি জাফলং বেড়াই। এই ১২ বছরের ব্যবধানে সেই জাফলং হারিয়ে গেছে। তখনকার নির্জন প্রকৃতিকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। পাথরকোয়ারি আর পাথর ক্রাশিং ফ্যাক্টরির একটানা ঘড়ঘড় শব্দে পিয়ান নদীর কলকল ধ্বনি শোনা যায় না। নদীজলের আর সেই স্বচ্ছতা নেই। পাথরের গায়ের ওপর দিয়ে তেমন করে আর জল গড়ায় না। নদীতীরে গঁজিয়ে ওঠা বেহিসাবি দোকানঘর জাফলংয়ের অন্যতম চোখজুড়ানো মনোহারী সবুজশ্যামল পরিবেশ সবটুকুই গ্রাস করেছে। যত্রতত্র হোটেল-রিসোর্ট চোখে পড়ল। তবে পথিমধ্যে নলছড়িতে জেলা পরিষদের দেখার মতো একটি ডাকবাংলো হয়েছে। আমরা জাফলং দর্শনে প্রশান্তির বদলে বুকভরা বেদনা নিয়ে ফিরতি পথে নলছড়ির ওই ডাকবাংলোতে ঢুকি। সেখানের ব্যালকনিতে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অবলোকনের ফাঁকে চা-নাশতা খেয়ে তামাবিল ঘুরে বিকেল ২টায় সিলেট শহরে ফিরি।
বিকেল ৫টায় বিভাগীয় কমিশনার কর্তৃক পুরস্কার বিতরণের মাধ্যমে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শেষ হয়। আমার হবিগঞ্জ জেলা সর্বোচ্চ পদক জিতে গত বৎসরের ন্যায় এ বছরও চ্যাম্পিয়ন হয়। আমি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দ নিয়ে দলেবলে হবিগঞ্জ ফিরে আসি।
৫ মার্চ ২০০৮, বুধবার। গতরাতে আগাম কালবৈশাখীর ঝড় ও মুষলধারায় বৃষ্টিপাত হয়। সকালে আকাশ একদম পরিষ্কার রৌদ্রময়। এবার সারাদেশেই সারের সংকট দেখা দিয়েছে- যার ধাক্কা হবিগঞ্জেও লেগেছে। এখন হাওড়ে লাগানো ধানের মধ্যবয়স। এ সময়ে ধানগাছগুলোর খাবারের চাহিদা বেশি থাকে। সার আর পানিই এদের প্রধান খাদ্য। গত রাতের বৃষ্টিতে বোরো ধানের বেশ উপকার হবে- এটা কৃষি বিশেষজ্ঞ না হলেও বোঝা যাচ্ছে।
আজ আমি সারাদিন বাসভবনের অফিসেই অফিস করি। কালেক্টরেট ভবনে আমার অফিসকক্ষে টাইলস্ বসানোর কাজ চলছে। ১৯৯৫ সালে এই ভবনটি নির্মিত হয়। তখন প্রকল্পে টাইলস্ ফিটিং ধরা ছিল না। এখন টাইলসের সহজলভ্য যুগ আসায় ঘরে ঘরে কার্পেট ফেলে তা লাগানো হচ্ছে।
আজও সন্ধের পর চারদিক অন্ধকার করে ঘণ্টাখানেক মুষলধারায় বৃষ্টিপাত হয়। এসময় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক এস.এ. খান ফোনে বলেন, আল্লাহর রহমতের বর্ষণ হয়েছে। সারের চাহিদা কমে আসবে। আমি বললাম, তাই যেন হয়। (চলবে…)