১ নভেম্বর ২০০৭ বৃহস্পতিবার থেকে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসির যাত্রা শুরু
আতাউর রহমান কানন
১ নভেম্বর ২০০৭, বৃহস্পতিবার। আজ থেকে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসির যাত্রা শুরু হয়। এ উপলক্ষ্যে সকাল ৯টায় আমার অফিসে জেলা জজশিপ কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগদান করি। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা বিচার ব্যবস্থার এই পরিবর্তন দেশের জন্য একটি মাইল ফলক বটে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জেলা প্রশাসকের ক্ষমতা খর্ব হওয়ার মর্মবেদনা থাকলেও আমি হাসি মুখে এ অনুষ্ঠানে পজিটিভ বক্তব্য রাখি। বিচার ব্যবস্থার কোন পদ্ধতি দেশের নাগরিকের জন্য মঙ্গলময় তা সময়ই একদিন রায় দিবে। তবু আমার মন এক পর্যায়ে সক্রেটিসের বিখ্যাত বাণী “I to die, and you to live. Which is better? Only God knows” এর সঙ্গে কোথায় যেন এর সাযুজ্য খুঁজে পেল। সারা দেশে আজ জেলা পর্যায়ে একযোগে এমনিভাবে আনুষ্ঠানিক পৃথক বিচার ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়েছে। আমার মতো অন্যান্য জেলা প্রশাসকগণও কি এমনভাবে ভাবছেন? হয়তো বা, নয়তো না। তবে যা হবার তা হয়ে গেছে।
মনের ভেতর উথালপাথাল ঢেউ যেমনই থাক না কেন, আমার পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রাম অনুযায়ী সাড়ে ১০টায় জাতীয় যুব দিবসের র্যালিতে নেতৃত্ব দিই। র্যালি থেকে ফিরে এ দিবসের ওপর আয়োজিত আলোচনাসভা এবং পুরস্কার ও ঋণ বিতরণ অনুষ্ঠানে যোগদান করি।
বিকেল আড়াইটায় পৌর সাধারণ পাঠাগারের সাধারণ সভায় যোগদান করি। টিমটিমে প্রদীপ জ্বলার মতো পাঠাগারটির আলো ঝলমলে প্রাণচঞ্চলতা ফিরিয়ে আনার জন্য কিছু কার্যক্রম নেওয়া হয়। পাঠককে টানার জন্য নিয়মিত পত্রপত্রিকা এবং মূল্যবান পুস্তক সংগ্রহের জন্য সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া মাঝে মাঝে বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করার সিদ্ধান্ত হয়। আজকের সভায় পাঠাগারের নতুন কার্যকরি কমিটিও সর্বসম্মতভাবে পুনর্গঠন করা হয়।
২ নভেম্বর ২০০৭, শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় সারাদিন বাসাতেই কাটাই। সন্ধে ৭টায় কিবরিয়া পৌর মিলনায়তনে হবিগঞ্জ সাংস্কৃতিক পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগদান করি। এই পরিষদ বিভিন্ন উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে থাকে। এবার আমার রচিত ১৫টি গান নিয়ে ‘‘জোনাকির আলোটুকু দাওনা আমায়” শিরোনামে এক জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে টিভি ও বেতারের বিশিষ্ট কণ্ঠ ও নৃত্য শিল্পীগণ অংশগ্রহণ করেন। এ ১৫টি গানের মধ্যে ১৪টি গানের সুরারোপ করেন বিশিষ্ট সুরকার হিমাংশু বিশ্বাস। আর একটি গান নিজস্ব সুরে পরিবেশন করেন শিল্পী সুবীর নন্দী। এ অনুষ্ঠানে হিমাংশু বিশ্বাসের কন্যা অন্তরা বিশ্বাসও একটি গান পরিবেশন করেন। হলভর্তি আমন্ত্রিত জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা, সুধীজন ও অন্যান্য দর্শক-শ্রোতা নিবিষ্ট মনে পুরো অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। এই অনুষ্ঠানের ভিডিয়ো স্থানীয় ক্যাবল চ্যানেলে সরাসরি প্রচার করা হয় এবং পরে বেশ কিছুদিন ধরে তা চ্যানেলে চলমান থাকে। এদিন আমার কাছে মনে হয়েছিল আমি শুধু একজন প্রশাসক নই, একজন অন্য ধারারও মানুষ। এই অনুষ্ঠান নিয়ে কবি ও কলাম লেখক তরফদার মুহম্মদ ইসমাইল দৈনিক খোয়াই পত্রিকায় একটি সচিত্র ফিচার লিখেছেন- “আমার দেখা একটি অনুষ্ঠান” নামে। নিম্নে পাঠকের জন্য অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো- ‘ গত ২ নভেম্বর সন্ধ্যায় স্থানীয় কিবরিয়া পৌর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হল হবিগঞ্জ সাংস্কৃতিক পরিষদের উদ্যোগে ঈদ পুনর্মিলনী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। হলভর্তি দর্শক-শ্রোতার সঙ্গে আমিও উপভোগ করলাম অনেকদিন পর একটি জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। হবিগঞ্জ সাংস্কৃতিক পরিষদ গঠনের পর সম্ভবত এটি তাঁদের প্রথম একটি মানোমুগ্ধকর অনুষ্ঠান। ইতঃপূর্বে উক্ত সাংস্কৃতিক পরিষদ ঢাকা থেকে ওস্তাদ এনে কিছুদিন ছাত্রছাত্রীদেরকে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সেটিও তাঁদের একটি উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম ছিল।
এ অনুষ্ঠানটি ছিল মূলত হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. আতাউর রহমানকে ঘিরে। তিনি এ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথিও ছিলেন। বহুবিধ গুণের অধিকারী এ ব্যক্তি আপাতদৃষ্টিতে একজন সফল ব্যক্তি হিসেবে প্রতীয়মান হল। আশা করি বাকি পথটুকু এমনিভাবে চলে সফলতার শিখরে পৌঁছবেন। কামনা করি তাঁর সাধনার সিদ্ধিলাভ হোক। বেশ কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উপলক্ষে নিমতলায় অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে ‘ফাগুন এসেছে’ নামে তাঁর লেখা কবিতাটি তাঁরই কণ্ঠে আবৃত্তি শুনেছিলাম। অত্যন্ত ভরাট ও সুললিত কণ্ঠে সুস্পষ্ট উচ্চারণে কবিতাটি আবৃত্তি করেন কবি আতাউর রহমান কানন। কবিতা ও আবৃত্তি দুই-ই ভালো লাগে। জানতাম, তিনি একজন কবি ও উপন্যাসিক। অনেক প্রকাশিত গ্রন্থ তাঁর রয়েছে এবং তিনি শৈশব হতেই লিখছেন। সাহিত্যের প্রায় সব কটি শাখাতেই তাঁর বিচরণ রয়েছে। এ জন্য অনেক পদক ও পুরস্কার লাভে সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। তবু সেদিন তাঁর সাহিত্য প্রতিভার স্বরূপ চাক্ষুষ দেখে অভিভূত হলাম। তৃপ্ত হলাম। কবির গীতিকবিতার স্বরূপ প্রকাশ পেল শুক্রবার সন্ধ্যার ‘জোনাকির আলোটুকু দাও না আমায়’ নামক গীতি অনুষ্ঠানে। আতাউর রহমান কাননের স্বরচিত এই গীতিকাব্যের সুরকার ছিলেন সিলেট বেতারের বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী, এককালের নজরুল সংগীতের বিশিষ্ট শিল্পী ও শিল্পকলা একাডেমির সংগীত শিক্ষক হিমাংশু বিশ্বাস। তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে আমি পূর্বেই জ্ঞাত ছিলাম। আলোক উজ্জ্বল, ঝলমলে, সাজানো গোছানো মঞ্চে গীতিকার আতাউর রহমান কাননের ১৫টি গান ১৫ জন কণ্ঠশিল্পী অপূর্ব গেয়েছেন। আর এর ১টি গানের ওপর নৃত্য পরিবেশন করেন সুরবিতান ললিতকলা একাডেমির ২জন নৃত্যশিল্পী। ভিন্ন স্বাদের জমকালো এই অনুষ্ঠানটি দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছে। সেটি অনুষ্ঠানস্থলের দর্শকদের মুহুর্মুহু করতালি ও হর্ষোচ্ছ্বাভাব দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। গীতিকবির লেখা অনুষ্ঠানটিতে পরিবেশিত ‘এই যে আমার দেশের মাটি’ প্রথম গানটি দেশের গান। বাকি ১৪টি আধুনিক গান। রোমান্টিক গানের চেয়ে বিরহগাঁথা গানের সংখ্যা বেশি হওয়ায় দর্শক প্রতিক্রিয়ার প্রশ্ন-জবাবের ক্ষণটিতে যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি আরও মনোজ্ঞ ও উপভোগ্য ছিল।
আমরা জানি, সংগীত এমনি এক মোহনী বিদ্যা যা মানুষের মনকে অতি সহজেই আকর্ষণ করে। সংগীত আত্মাকে দেয় শান্তি। এ সংগীতের মধ্যে কণ্ঠসংগীতই প্রধান। আলোচ্য অনুষ্ঠানে গীতি কবির একটি গান এ দেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী নিজে সুরারোপ করে গেয়ে শোনান। কথা-সুর-কণ্ঠ এর একটি অপূর্ব মিলনে গানটি খুবই ভালো হয়েছে। যন্ত্রসংগীতের সমন্বয় আরো একটু ভালো হলে গানটি আরও অপূর্ব হতো। যন্ত্র সংগীত কণ্ঠসংগীতকে মাধুর্যপূর্ণ করে তোলে। তবে তবলাবাদক রাজু রায় সর্বসময়ই যথার্থ তবলা সঙ্গত করতে সচেষ্ট ছিলেন। সুরকার হিমাংশু বিশ্বাস প্রতিটি গানের সুরই মনোজ্ঞ করতে চেষ্টা করেছেন। পরিবেশিত গানগুলোর সুরলহরীতে ‘কলাবতী রাগ’ ও ‘ভৈরবী’ এর প্রাধান্য বেশি লক্ষ্য করা গেছে। ফলে এই ধারার স্বর সংযোগে গানগুলো পরিবেশিত হয়েছে। বিভিন্ন রাগে গীত হলে গানগুলো আরও চমৎকৃত হতো বলে আমার মনে হয়। সুরকার তবু সফল।
গীতিকাব্যের কথা ও শব্দ যোজনায় গীতিকার আতাউর রহমান কানন অত্যন্ত সচেতন ছিলেন শুধু তা-নয়, বরং এ কাব্যগীতগুলো গীত হওয়ায় গীতিকার যে সত্যই একজন প্রতিভাবান কবি তাও তাঁর কাব্যশক্তির প্রখরতায় প্রকাশ পেল।’
৪ নভেম্বর ২০০৭, রবিবার। সকাল সাড়ে ৮টায় আমার বাসায় ছবিসহ ভোটার তালিকা ও এনআইডি কার্ড প্রণয়নের আনুষ্ঠানিক তথ্য সংগ্রহের কাজ উদ্বোধন করি। আজ আমার তথ্যাদি সংগ্রহের মাধ্যমেই এ জেলায় তথ্য সংগ্রহের কাজের সূচনা হয়। এরপর সকাল ১০টায় আমি ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করি। আগামীকাল হতে দুদিনব্যাপী প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে আইসিটি এবং ই-গভার্ন্যান্সের ওপর প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করব। বিকেল ২টায় ঢাকার বাসায় পৌঁছে লাঞ্চ করে বিশ্রাম নিই।
৭ নভেম্বর ২০০৭, বুধবার। গত দুদিন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছি। আজ সন্ধ্যার পর হবিগঞ্জে ফিরে যাব। সকালের দিকে ঢাকার বাসার জন্য বাজারসদাই করি। বাদ মাগরিব সাড়ে ৭টায় হবিগঞ্জের উদ্দেশে রওনা করে সাড়ে ১০টায় হবিগঞ্জের বাসায় পৌঁছি। আমি যখন বাসার গেট দিয়ে ঢুকেছি, ঠিক তখনই বিভাগীয় কমিশনার আমার হাজিরা নিশ্চিত করার জন্য মোবাইলে কল দেন। আমি সালাম দেওয়া মাত্র অন্যকোনো কথা না বলে আমাকে ল্যান্ড ফোনে কথা বলার নির্দেশ দেন। বস্ বলে কথা! গাড়ি থেকে নেমেই বাসভবনের অফিসে বসে ফোন করলাম। তিনি নিশ্চিত হলেন- আমি ফিরেছি। তখন একথা-সেকথা বলে ফোন ছাড়লেন। সিনিয়র অফিসার এভাবে জুনিয়রের পিছে লেগে থাকা ভালো না মন্দ কিছুই ভাবলাম না। (চলবে…)