আই এ চৌধুরী শরীফ ইউকে
খুব জরুরী প্রয়োজন ছাড়া আসলে ঘর থেকে বাইরে যাওয়া হয় না। চারিদিকে এক নিঃশব্দ নীরবতা। যেন এক অঘোষিত যুদ্ধ চলছে। হাল, ইংল্যান্ডের নর্থ ইস্টের ছোট ১টি শহর। লক ডাউনের ফলে রাস্তায় নেই কোন ট্রাফিক জ্যাম। নেই চিরচেনা কোলাহল পার্কে, ষ্টেশনে, ক্লাবে কিংবা অলি-গলিতে, অজানা আতংকে মাঝে মাঝে নিজেই চমকে উঠি। একটু মাথা ব্যাথ্যা, সর্দি কিংবা কাশি দিলেই মনে হয় এই বুঝি এসে গেলো। তথ্য প্রযুক্তির এই সময়ে সমগ্র বিশ্ব এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। মিডিয়ার কল্যান সবসময়ই আপডেট পাচ্ছি। আজ মৃতের সংখ্যা/সংক্রমনের সংখ্যা পৃথিবীর এই দেশে এত ছড়িয়ে গেল। এটা সম্ভবত, কোন দেশই কল্পনা করেনি চায়না থেকে এই ভাইরাস এত দ্রুত বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়বে। সেজন্যেই পৃথিবীর সচেয়ে শক্তিধর দেশ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরুর দিকে বলেছিলেন এটি তেমন কিছুনা কেবল সামান্য সর্দি জ্বর। সামার আসলে এমনিতেই চলে যাবে। করোনা ভাইরাসকে তিনি চায়নিজ ভাইরাস বলে ব্যাঙ্গ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। “তোমাকে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে” রবীন্দ্রনাথের এ চরন তার জানা ছিল না। আজ যখন এ লেখা লিখছি সি.এন.এন এর তথ্য অনুযায়ী আমেরিকাতে মৃতের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এখন সাংবাদিকদের সাথে হোয়াইট হাউসের নিয়মিত ব্রিফিংকে “টাইম ওয়েস্টিং” বলে অভিহিত করেছেন। কারণ সাংবাদিকদের উল্টা পাল্টা প্রশ্ন কাহাটক সহ্য করা যায়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন স্বীকার করেছেন করোনা ভাইরাস নাইন ইলেভেন কিংবা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে সংঘটিত জাপান কর্তৃক পার্লহার্বারের বোমা হামলার চেয়েও অনেক ভয়ানক। আমার নিজের স্বল্প জ্ঞান ধারা এটাই মনে হয় সারা পৃথিবীর নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের উপর কারণে অকারণে যুদ্ধের বলির অভিশাপ হিসেবে আল্লাহ এই ভাইরাস নাজিল করেছেন। অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি পাশ্চাত্যের উন্নত প্রযুক্তির দেশগুলো এই ভাইরাস মোকাবেলায় কতটা অসহায়। এই ভাইরাস বরিস জনসন, প্রিন্স চার্লস কিংবা জ্যাস্টিন ট্রোডো কিংবা কাউকেই পরোয়া করেনা।
সাউথ কোরিয়া কিংবা জার্মানীর দিকে যদি নজর দেই তাহলে কি দেখতে পাই। কোরিয়ান সরকার এবং জনগণ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তা মোকাবেলা করেছে। ফলে মৃত্যুহার এবং ইনফেকশন রেইট দুটুই প্রায় শূণ্যের কোটায়। এই দুর্যোগপূর্ণ অবস্থার মাঝে ইলেকনশনেও জনগণ মি: মুনের সরকারকে বিপুলভাবে বিজয়ী করেছে। অন্যদিকে জার্মানীর অবস্থা ইউরোপে সবচেয়ে ভালো। মৃত কিংবা আক্রান্তের সংখ্যা অত্যন্ত কম। সি.এন.এন এর রিপোর্ট অনুযায়ী চ্যান্সেলার এঞ্জেলা মার্কেলের জন্য বছরের শুরুটা ছিল খুব খারাপ। রাজনৈতিকভাবে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না। কিন্তু এ করোনা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করার জন্য তার জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। করোনা আসলে মিসেস মার্কেলের জন্য শাপে বর হয়ে দাড়িয়েছে।
আর আমাদের দেশের চিত্র একবারেই ভিন্ন। জাতির এ দুঃসময়ে ও আমরা রাজনৈতিক কাদা ছুরাছুড়িতে ব্যস্ত। এ রকমের রাজনীতিতে সম্ভবত: আমরাই ওস্তাদ। রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে যেখানে দুর্দশা গ্রস্থ: নিপিড়িত মানুষের পাশে দাড়ানো সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেখানে আমাদের দেশের নেতা নেত্রীরা হাটছেন তার উল্টো পথে। যা দেশের জন্য কোনক্রমেই মঙ্গল বয়ে আনতে পারেনা। চাল চোর কিংবা তেল চোররা তো শুধু সমাজ, দেশ কিংবা মানবতারই শক্রু নয় ওরা যে আওয়ামীলীগ তথা সরকারী দলের “ঘরের শক্রু বিভীষন” এ সত্যটি আওয়ামীলীগের হাইকমান্ড যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন ততই ভালো। আমি ভেবেছিলাম “কাতেল হুসেন আসল মে মরগিয়া এজিদ হে”। না ধারনা মিথ্যে। এজিদ তথা এই হায়েনারা মরেনি। এদের শক্ত হাতে দমন করা প্রয়োজন।
এই বিপদের সময় সরকারের দায়িত্বশীল একেক মন্ত্রীর একেক রকম নসিহত শুনে হাসবো না কাদবো ভেবে পাইনে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী টেলিভিশনে বিনোদন মূলক অনুষ্ঠানের আহব্বান জানিয়েছেন। টেলিভিশনে বিনোদনমূলক অনুষ্টানের সাথে করোনা ভাইরাসের বাড়া কমার কি সম্পর্ক তা বোধগম্য নয়। যদি বলতেন রেডিও, টেলিভিশনের জনগনকে সতর্কীকরণের জন্য কোন ধরনের প্রামান্যচিত্র বা এ জাতীয় ঘোষনা দেওয়ার জন্য তাহলে কি ভালো হতোনা। যা পৃথিবীর উন্নত দেশ গুলোকে সবসময় করা হচ্ছে। আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক তথা সেতুমন্ত্রী অনেক আগেই ঘোষনা দিয়েছিলেন করোনা থেকে আওয়ামীলীগ সরকার অনেক শক্তিশালী। আড়াই বড়াই যে সবসময় ছলেনা তা বোধহয় মন্ত্রী মহোদয় নিজেই এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
এখন বুঝতে পারি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু কতটা অসহায় ছিলেন। একে তো যুদ্ধবিধস্ত দেশ। তার উপরে নেই রাস্তঘাট কিংবা কোন কল কারখানা। উপরূন্ত আশীর্বাদ হিসাবে ৭৪এর বন্যা মরার উপর করার ঘা। এখনকার মতো ছিলনা প্রিন্ট কিংবা ইলেকট্রনিক তথা সোস্যাল মিডিয়া যার কল্যানে মূহুর্তেই খবর পৌছে যাবে আইনশংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। বাংলাদেশের পুলিশকে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে দেখতে পাচ্ছি এ করোনা মোকাবেলায় অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়ে সেবা দিতে। ধন্যবাদ বাংলাদেশ পুলিশকে। আমরা আপনাদের এই রূপটিই দেখতে চেয়েছিলাম গুটিকয়েক এমপিদের ধান কাটার নির্লজ্জ ক্যামেরা ট্রায়ালের চেয়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ তথা কৃষকলীগের সাধারণ মানুষের প্রতি সহযোগিতা অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দুর্ভাগ্য শুধু একটাই তার জন্ম বাংলাদেশে। জাতির এ দুর্দিনে কোথায়তার প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের করোনা ভাইরাস কিট আবিস্কারকে যুগান্তকারী হিসেবে অভিনন্দিত করা হবে তা না করে ঔষধ প্রশাসন যে, তামাশা শুরু করেছে তা রীতিমত অমার্জনীয় অপরাধ। সব কিছুতেই আমরা রাজনীতি নিয়ে আসি-এটাই আমাদের আরেক মুদ্রাদোষ। ইউরোপ কিংবা আমেরিকা হলে তাকে তারা মাথায় তুলে রাখতো তা নিসন্দেহে বলতে পারি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে যদি সবকিছুতেই হস্তক্ষেপ করতে হয় তা হলে এই সমস্ত চেলা চামুন্ডাদের দরকারটা কি?
মানবতার সেবায় ভিক্ষুক নাজিমুদ্দীন সরকারী তহবিলে ১০ হাজার টাকা দান ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এটা তবে ভুলে গেলে চলবেনা যে, রাষ্ট্র যখন ১জন ভিক্ষুকের কাছে দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য হাত পাতে তখন কথায় কথায় আমাদের নেতা-নেত্রীরা যে দেশ মালয়েশিয়া কিংবা সিংগাপুর হয়ে যাচ্ছে বলে বেড়ান তা শুধুই ফাঁকা বুলি।
সবশেষে শুধু এটুকুই বলতে চাই আমাদের রাজনৈতিক মত পাথর্ক্য আছে এবং তা থাকবেই যা গণতন্ত্রের অংশ। কিন্তু মহামারী মোকাবেলায় আমরা কি পারিনা সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক সঙ্গে করোনা ভাইরাসের বিরোদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে পারি না । সেই বিখ্যাত কবিতার দুটো লাইন আজ খুব মনে প[ড়ছে।
“মেঘ দেখে করিসনে ভয়
আড়ালে তার সূর্য হাসে”
আমরা সেই হাসির অপেক্ষাতেই আছি। তবে তা কতদূর?