
কুশিয়ারা নদীর তীরে মার্কুলি বাজারটি ব্রিটিশ আমল থেকেই একটি বন্দর শহর ছিল
এ বাজারে লঞ্চ-স্টিমার ভিড়ত। পুরাতন দালানকোঠা এখনো কালের সাক্ষী। বড় বড় লঞ্চ-স্টিমার না হলেও এখন ছোট ছোট লঞ্চ-নৌকা চলাচল করে
আতাউর রহমান কানন
৬ মার্চ ২০০৮, বৃহস্পতিবার। আজ আমার বানিয়াচং উপজেলার দুর্গম মার্কুলি এলাকাসহ কয়েকস্থানে দিনব্যাপী কর্মসূচি রয়েছে। আমি সে কর্মসূচির প্রস্তুতি নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টায় বানিয়াচং উপজেলার উদ্দেশে রওনা করি। বানিয়াচং ইউএনও অফিসে পৌঁছে সেখানে আয়োজিত ‘মাতৃসেবা ভাউচার স্কিমের ইনসেনটিভ প্রদান অনুষ্ঠানে যোগদান করি। গর্ভবতী মায়েদের গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালীন এবং পরবর্তী সময়ে এই স্কিমের আওতায় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়ে থাকে। প্রত্যেক মাকে দুই হাজার টাকা করে ইনসেনটিভ প্রদান করা হয়। মোট ৯৭ জন মা আজ এই অনুষ্ঠানে তাদের নবজাতক শিশুসহ উপস্থিত হন।
বেলা ১২টায় ইউএনওসহ হাওড়ের ভেতর দিয়ে কাগাপাশা ইউনিয়ন এলাকার মেঠোপথে মার্কুলির দিকে যেতে থাকি। বর্ষায় যেমন হাওড়ে ঢেউ থাকে, ঠিক তেমনি আমাদের যাত্রাপথ ঢেউ খেলানো। হাওড়ের এসব পথে শুকনো মৌসুমে ট্রাক্টর ও গরু-মহিষের গাড়ি চলাচল করায় রাস্তার এমন দশা। এখন হাওড়জুড়ে যৌবনা সবুজ ধানের খেত। মুখে মুখে থোর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বসন্ত হাওয়ায় গতরাতে বৃষ্টিস্নাত ধানগাছের চিরল পাতারা হেলেদুলে নাচানাচি করছে। এসব প্রাকৃতিক শোভা উপভোগে ব্যস্ত থাকায় সারাপথে গাড়ির ঝাঁকুনির কথা বেমালুম ভুলেই ছিলাম। হাওড়ের নির্জন রাস্তার মাঝামাঝি একদল লোক আমাদের গাড়ি থামায়। আমি কিছুটা ভরকে যাই। ইউএনও বলেন, স্যার, চেয়ারম্যান।
আমি তাকাতেই চেয়ারম্যান সালাম দিয়ে গাড়ি থেকে নামতে অনুরোধ জানান। লোকজন নিয়ে এভাবে পথ আগলে চেয়ারম্যান কেন দাঁড়িয়ে আছেন- সে প্রশ্ন না করে আমি রোবটের মতো নেমে পড়ি। তখন তিনি টুপ করে আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বললেন- স্যার, এই প্রথম আমার ইউনিয়নের মাটিতে কোনো জেলা প্রশাসক পা রাখলেন।
হাওড়ের রাস্তা পেরিয়ে টিলা শ্রেণির চমকপুর গ্রামের মধ্যি দিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টায় আমরা দৌলতপুর ইউনিয়নের মার্কুলি বাজার বাইপাস করে আমার পূর্বনির্ধারতি কর্মসূচি অনুযায়ী প্রথমে কাদিরগঞ্জ হাইস্কুলে যাই। সেখানে আমার আগমন উপলক্ষ্যে আয়োজিত ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সম্মেলনে যোগদান করি। এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ অনেক সুধীজন আমন্ত্রিত হয়ে এই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। আমাকে ফুলের তোড়া-মালা পরিয়ে এবং মানপত্র পাঠে অভিনন্দন-স্বাগতম জানানো হয়। হাওড় এলাকার অতীত-ঐতিহ্যের ধারক ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রদত্ত সংবর্ধনায় আমি যারপরনাই মোহিত। অনুষ্ঠানে এলাকার বিশিষ্টজনের অনেকেই তাঁদের বক্তব্যে বলছিলেন যে, এবারই প্রথম কোনো জেলা প্রশাসক এই প্রত্যন্ত এলাকায় এসেছেন বলে তাঁরা বেশ গর্বিত ও অভিভূত!
কাদিরগঞ্জ হাইস্কুলের অনুষ্ঠান শেষে এবার ঐতিহ্যবাহী মার্কুলি বাজারে যাই। আমি হবিগঞ্জে চাকরিকালীন মার্কুলি বাজারের অনেক নাম শুনেছি। কিন্তু দুর্গম বিবেচনায় এখানে আসা হয়নি। আজ এসে মনে হলো- না এলে অনেক কিছুই মিস করতাম। ফাল্গুনের ফুরফুরে মৃদু হাওয়া গায়ে মাখিয়ে বাজারটি ঘুরেফিরে দেখি। কুশিয়ারা নদীর তীরের এই বাজারটি ব্রিটিশ আমল থেকেই একটি বন্দর শহর ছিল। লঞ্চ-স্টিমার ভিড়ত। পুরাতন দালানকোঠা এখনো কালের সাক্ষী। আমি বাজারটির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির ঘাটে গিয়ে কোমরে দুহাত রেখে কিছুটা সময় উদাসী মনে তাকিয়ে থাকি। বড় বড় লঞ্চ-স্টিমার না হলেও এখনও ছোট ছোট লঞ্চ-নৌকা চলাচল করে। এর ওপারেই সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা। চেয়ারম্যান জানালেন, স্যার, ওই দিরাইয়ের উজানধল গ্রামে বাউল শিল্পী শাহ আবদুল করিমের বাড়ি। প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক লোক তাঁকে দেখতে আসেন। আপনি যেতে চাইলে নিয়ে যেতে পারি। তৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়ল বাউল সম্রাটের বিখ্যাত গানের কলি ‘বসন্ত বাতাসে সইগো, বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ, আমার বাড়ি আসে, সই গো বসন্ত বাতাসে।’
আমি আমার উদাসী মনটা টেনে ধরে চেয়ারম্যানের কথার জবাব না দিয়ে শুধু তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি আবার বললেন, যাবেন স্যার?
এবার আমি বললাম, আজ সময় হবে না। আরেক দিন।
এলাকার লোক মার্কুলির ঐতিহ্য নিয়ে এখনও গর্ববোধ করেন। তাদের সাথে কথা বলে অনেক কিছুই জানলাম। গল্পও বেশ জমে ওঠে; কিন্তু আমাদের আবার হাওড়ের দুর্গম মেঠোপথ পাড়ি দিতে হবে। হাতে তেমন সময় নেই। জেলা সদর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে আছি। তাই সময় হিসেব করে বিকেল ৪টায় এ প্রত্যন্ত এলাকাবাসীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হবিগঞ্জ সদরের উদ্দেশে রওনা করি। অনেকটা পথ এলাকাবাসীর নির্মল আবেগের সাথে আমার আবেগ একাকার হয়ে হাওড়ের আকাশে বাতাসে ওড়তে থাকে।