(মোঃ আতাউর রহমান ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই বছর হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ছিলেন। হবিগঞ্জে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি নিজের ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন। তাঁর সেই ডায়েরিতে ফুটে উঠেছে হবিগঞ্জের বৈচিত্রময় চিত্র। দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকার পাঠকদের জন্য তাঁর ডায়েরি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে-)

ডিসিরা জেলায় সরকারের প্রতিনিধি, তাঁদের কাজ সরকারি আদেশ-নির্দেশ বাস্তবায়ন ॥ দলীয় মত প্রকাশে তাঁদের হাতপা বাঁধা

আতাউর রহমান কানন

২৭ নভেম্বর ২০০৬, সোমবার। সকালে অফিসে যাওয়ার পর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আমার কাছে এসে জানান, গতকাল বিকেলে হবিগঞ্জ জেলার জন্য পাঠানো নির্বাচনি সামগ্রী তিনি রিসিভ করে পুলিশ প্রহরায় মালখানায় রেখেছেন। আমি তাঁকে ‘গুড’ বলে নির্দেশনা দিলাম- নিয়মিত খেয়াল রাখতে। এছাড়া পোলিং পারসোনেলদের তালিকাটি এডিসি জেনারেলের সঙ্গে বসে হালনাগাদ করতেও নির্দেশ দিই। প্রয়োজনে ইউএনওদের নিকট পাঠিয়ে তালিকা হালনাগাদ করে আনতে হবে। তিনি ‘জি স্যার, জি স্যার’ বলে চলে গেলেন।
আজ সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশন মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পরামর্শ করে আগামী ২১ জানুয়ারি ২০০৭ বাংলাদেশের ৯ম সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে।
এছাড়া প্রধান উপদেষ্টা দুই জন নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেন। এদের একজন- সাবেক আইজিপি মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী, যিনি অবসরে যাওয়ার পর হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ-বানিয়াচং সংসদীয় আসনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে লড়বেন বলে কাজ করে যাচ্ছিলেন। আর অপরজন সাবেক জেলা জজ জনাব সাইফুল আলম।
এদিন রাতেই প্রেস-মিডিয়ার প্রশ্নের উত্তরে উপদেষ্টাগণ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ ও নতুন ২ জন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিষয়ে কিছুই অবহিত ছিলেন না বলে ক্ষোভের সঙ্গে জানান।
পক্ষান্তরে ১৪দলীয় মহাজোট এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করে এবং নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়। আমি কেন্দ্রীয় সরকারের মাঠ প্রশাসনের একজন প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে পেলাম, রাজনৈতিক আকাশে আবার বিদ্যুতের বিধ্বংসী ঝলকানি।
২৮ নভেম্বর ২০০৬, মঙ্গলবার। আমি সকালে অফিসে গিয়ে এডিসিদের নিয়ে বসলাম। তাঁদের মনের অশান্তির ছাপ মুখমন্ডলে প্রতিভাত। দেশ কোথায় যাচ্ছে? যাক, কী আর করা! আমরা এভাবেই প্রশাসনিক কাজকর্ম নিয়ে দিন কাটাতে থাকি। আর রাজধানী ঢাকায় ১৪দলীয় জোট ও ৪দলীয় জোট পাল্টা-পাল্টি অবস্থান নিয়ে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর যে ৪দলীয় জোটের ভূতুড়ে প্রভাব রয়েছে, তা দলকানা ছাড়া দেশের বোঝদার জনগণের আর বুঝতে বাকি নেই।
২৯ নভেম্বর ২০০৬, বুধবার। মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, অশান্তি যাই থাকুক না কেন ডিসিরা জেলায় সরকারের প্রতিনিধি। তাঁদের কাজ সরকারি আদেশ-নির্দেশ বাস্তবায়ন। কোনো দলীয় মত প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁদের হাত-পা বাঁধা। ডিসি হিসেবে আমি নির্বাচনের কাজকে অগ্রাধিকার দিয়েই আমার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।
আজকে বাংলাদেশের প্রথম নোবেল প্রাইজ বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনুসকে ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃক নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই সংবর্ধনার বক্তব্যের এক পর্যায়ে ড. ইউনুস চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের উপায় হিসেবে একটি কোয়ালিশন সরকারের রূপরেখা দেন। তা হলো- বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলো শান্তি চুক্তির মাধ্যমে আসন্ন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে। এই নির্বাচনে হেরে যাওয়া দল বা জোট ১০০ আসন পাবে। এরপর দেশে সর্বদলীয় কোয়ালিশন সরকার গঠন করবে। এই সরকারের মেয়াদ হবে এক বছর। এই কোয়ালিশন সরকার তাদের মেয়াদের মধ্যে ভবিষ্যতের জন্য একটি দীর্ঘ মেয়াদি সমাধান বের করবে।
দুপুরের দিকে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি ক্রেইগ জেনাস পররাষ্ট্র সচিবের সাথে বৈঠক করে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপায় বের করার জন্য পরামর্শ পেশ করেন।
এদিন সন্ধ্যায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা মোখলেছ চৌধুরী মহামান্য রাষ্ট্রপতির বার্তা নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার কাছে যান। এই বার্তাতে রাষ্ট্রপতি বর্তমান সংকট ও নির্বাচনের পুনঃতফসিল বিষয়ে উভয়ের সাথেই আলোচনায় বসার জন্য সদিচ্ছা ব্যক্ত করেন।
৩০ নভেম্বর ২০০৬, বৃহস্পতিবার। আমার অফিস ও ব্যক্তিগত জীবন থেমে থাকে না। সারাদিন অফিস চলে। দিনের আলো নিভে সন্ধ্যা নামে প্রকৃতির বাঁধহীন নিয়মে। পক্ষান্তরে আমাদের টেনিস মাঠে ঝলমলে আলো জ্বলে ওঠে। আমি সে মাঠে নিয়মিত টেনিস খেলি। পুলিশ সুপার আমার পার্টনার হওয়ায় আমাদের জুটি বেশ শক্ত অবস্থানে। প্রায় প্রতিদিনই আমরা জিতে বাসায় ফিরি। আজ কেন যেন জিততে পারলাম না। আমাদের প্রতিপক্ষ আমাদের চেয়ে ইয়ং এবং বেশ ভালো খেলোয়াড়। তবু হারার পর মনটা পরাজয় মানতে চায় না। আজ পরাজয়ের গ্লানি নিয়েই জীপে চড়ে বাসায় আসতে আসতে ভাবলাম, সামান্য নিত্যকার স্বাস্থ্য রক্ষার খেলায় হেরেই যেখানে মন খারাপ হয়, সেখানে দেশের ক্ষমতা লাভের রাজনীতির খেলার হার কেউ কি মানতে পারে? বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে টিভি অন করতেই দেখি- বিক্ষুব্ধ অ্যাডভোকেট-জনতা প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস ভাঙচুর করেছে। এছাড়ার বিগত সরকারের আইন প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের গাড়িও ভাঙচুরের কবলে পড়েছে। এই ঘটনার কারণ হিসেবে সংবাদে বলা হচ্ছে- রাষ্ট্রপতির তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে দায়েরি রিট পিটিশনসমূহ মহামান্য প্রধান বিচারপতি একক সিদ্ধান্তে স্থগিত করায় এই ঘটনা ঘটে।
১ ডিসেম্বর ২০০৬, শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আমি ধীরে সুস্থে নাশতা খেয়ে বাসভবনের অফিসে বসে কিছু জরুরি কাজ করছিলাম। এমন সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য শহীদ চৌধুরী আমার সঙ্গে সাক্ষাতে আসেন। তিনি হবিগঞ্জ শহরেরই শায়েস্তানগরের বাসিন্দা এবং অন্যতম নিপাট ভদ্রলোক। তাঁকে ১৯৯২ সাল থেকেই চিনি। তখন তিনি হবিগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। এত বিনয়ী ও সুমধুর আচার-আচরণের মানুষ কদাচিৎ দেখা যায়। তিনি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত। প্রবাসীদের অর্থায়নে হবিগঞ্জ পৌর এলাকায় খোয়াই নদীর তীরে একটি ডায়াবেটিস ও জেনারেল হাসপাতাল নির্মাণাধীন রয়েছে, যা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই চালু হবে। তিনি সে প্রকল্পের সভাপতি হিসেবে আমাকে সেটা দেখার জন্য প্রস্তাব করেন। আমি তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হই; তবে অন্য একদিন সময় করে যাব বলে জানাই।
আজ রাতের সংবাদে জানা গেল, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ ১৪-দলীয় জোট প্রধান এবং চারদলীয় জোট প্রধানদের সাথে পৃথকভাবে চলমান সঙ্কট নিরসনের জন্য বৈঠক করেন, যার ফলাফল শূন্য। উপরন্তু বিএনপি হাইকমান্ড থেকে জানানো হয় যে, কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল কি করল না, সেটা বিবেচনায় না নিয়ে যেকোনো মূল্যে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ীই নির্বাচন হতে হবে।
চলবে…