(মোঃ আতাউর রহমান ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই বছর হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ছিলেন। হবিগঞ্জে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি নিজের ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন। তাঁর সেই ডায়েরিতে ফুটে উঠেছে হবিগঞ্জের বৈচিত্রময় চিত্র। দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকার পাঠকদের জন্য তাঁর ডায়েরি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে-)

হবিগঞ্জ বেশ দাঙ্গা-হাঙ্গামার জেলা, তাই সাবধানতার সাথে কৌশলে চলার পরামর্শ দেন বিভাগীয় কমিশনার

হবিগঞ্জের কৃতী সন্তানদের একটি দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। ইতিহাসে স্থান করে নেওয়া এসব ব্যক্তিত্ব ভারতবর্ষের ব্রিটিশ স্বাধীনতা আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গৌরবময় অবদানের জন্য বিখ্যাত হয়েছেন
আতাউর রহমান কানন

২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৬, সোমবার। মাহে রমজানের প্রথম দিন। সকালে কিছুক্ষণ অফিস করে আমি সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের অফিসের উদ্দেশে রওনা করি। কমিশনার মহোদয়ের দেওয়া সময়ানুযায়ীই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি আমার ভালোমন্দ খোঁজখবর নিলেন এবং কিছু পরামর্শ দিলেন। হবিগঞ্জ বেশ দাঙ্গা-হাঙ্গামার জেলা, তাই সাবধানতার সাথে কৌশলে চলার জন্যও পরামর্শ দেন। এরপর তিনি এটাও বললেন, শুনেছি, তুমি এর আগে দীর্ঘদিন হবিগঞ্জে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলে, লোকজন তোমাকে ভালো জানে। এখন তুমি সেই ভালোটা ধরে রাখলেই তোমার জেলা চালাতে কোনো অসুবিধা হবে না। আমি আদবের সাথে সাথে ‘জি স্যার-জি স্যার’ করলাম। সাক্ষাৎ শেষে সোজা হবিগঞ্জের উদ্দেশে রওনা করি। বিকেল সাড়ে তিনটায় নিজ অফিসে ঢুকি এবং কাজকর্ম শেষ করে ৪টায় বাসায় ফিরে আসি।
২৬ সেপ্টম্বর ২০০৬, মঙ্গলবার। আজ সকাল থেকে পূর্বনির্ধারিত ৫টি সভায় যোগদান করি। এসবের মধ্যে একটি ছিল- স্থানীয় গণ্যমান্যদের সাথে সৌজন্যমূলক মতবিনিময় সভা। জেলায় দলমত-পেশা নির্বিশেষে একটি গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের তালিকা থাকে। তালিকাটি আবার সময়ের প্রয়োজনে হালনাগাদ করা হয়ে থাকে। এই তালিকাভুক্ত ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়, সরকারি কিংবা জাতীয় অনুষ্ঠানসমূহে গুরুত্ব অনুযায়ী আমন্ত্রিত হন। আমি আজ তাঁদের নিয়ে সভা করলাম। এঁদের অধিকাংশ আমার পূর্বপরিচিত। বিশেষ করে অ্যাডভোকেট চৌধুরী আবদুল হাই, শহীদ চৌধুরী, অ্যাডভোকেট আফরাজ আফগান চৌধুরী, অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খান, অ্যাডভোকেট আফরোজ বখত চৌধুরী, অ্যাডভোকেট আবুল খায়ের, অ্যাডভোকেট আলমগীর ভূঁইয়া বাবুল, অ্যাডভোকেট দেওয়ান মসউদ চৌধুরী, অ্যাডভোকেট পূণ্যব্রত চৌধুরী বিভু, অ্যাডভোকেট আমির হোসেন, অ্যাডভোকেট মনসুর উদ্দিন ইকবাল, অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহির, অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান, সাংবাদিক হারুনুর রশিদ চৌধুরী, জাহানারা আফসার, ডা: জমির আলী, রইছ মিয়া, জি কে গউছ, সৈয়দ আহমদ হোসেন শাহ্ সাহেব, আশরাফ উদ্দিন, আবুল কাশেম, মো. মোতাব্বির হোসেন প্রমুখ। এঁরাই জেলার উকিল বার থেকে প্রেস ক্লাব, ব্যবসা-বাণিজ্য, সমাজ-রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তাঁদের কাছে জেলার অনেক কিছুই জানলাম। তাঁরা আমাকে পেয়ে নিজেদের লোক ভেবে প্রশংসায়ও কম যান না। এছাড়া আমার যে কোনো রকম সহযোগিতায় তাঁরা পাশে থাকবেন বলে জানান। অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে জেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আমার আজকের সৌজন্য মতবিনিময় সভাটি শেষ হয়।
হবিগঞ্জ আমার অতিপরিচিত একটি জেলা। আমি আগে একাধারে পাঁচ বছর এ জেলায় চাকরির সুবাদে এর মাটি-মানুষ-সংস্কৃতির সাথে পরিচিত। এ জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য বেশ সমৃদ্ধ ও গৌরবময়। আমার লেখায় এ সমস্ত তুলে ধরাকালে আমি যখনই জেলার কোনো স্থানে ভ্রমণ করি সেখানের দর্শনীয় স্থান ও খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।
ঐতিহাসিক সুলতানসী হাবেলীর প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ সুলতানের অধস্তন পুরুষ সৈয়দ হেদায়েত উল্লাহর পুত্র সৈয়দ হবিব উল্লাহ খোয়াই নদীর তীরে একটি গঞ্জ বা বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নামানুসারে বাজারটি হবিবগঞ্জ হিসেবে পরিচিতি পায়। এই হবিবগঞ্জ কালক্রমে হবিগঞ্জে পরিণত হয়। ইংরেজ শাসনামলে ১৮৬৭ সালে আসাম প্রাদেশিক সরকার হবিগঞ্জকে মহকুমা ঘোষণা করে। পরবর্তীতে লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এর শাসনামলের শুরুতে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীয়করণের ফলশ্রুতিতে ১৯৮৪ সালের ০১ মার্চ হবিগঞ্জ মহকুমা থেকে জেলায় উন্নীত হয়। আর সেই সাথে এর অধীনস্থ ৮টি প্রশাসনিক থানাও উপজেলায় উন্নীত হয়।
এই জেলার ভূমিরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যরে এক লীলাভূমি। পাহাড়-টিলা, সমতল এবং হাওড়-বাঁওড় রয়েছে বিস্তৃতভাবে। চা বাগান, রাবার বাগান আর অভয়ারণ্য বনবনানীর প্রাকৃতিক শোভায় যে কারও মন হরণ করে নিমিষে। জেলায় রয়েছে ২৪টি চা বাগান, ৩টি রাবার বাগান আর সাতছড়ি-রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য।
এ জেলা প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদেও ভরপুর। বিবিয়ানা, রশিদপুর ও হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ড তিনটি থেকে দেশের উল্লেখযোগ্য গ্যাসের চাহিদা মেটানো হয়। আর শাহজীবাজারসহ বেশ কয়েকটি স্থানে রয়েছে পর্যাপ্ত সিলিকা বালু, যা দেশের কাচ ও সিরামিক শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব ছাড়াও দর্শনীয় স্থান হিসেবে রয়েছে- ১. মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ, ২. চুনারুঘাট মুড়ারবন্দে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (র.)-এর মাজার। ৩. শাহাজীবাজারে সৈয়দ ফতেহ গাজী (র.)-এর মাজার, ৪. বানিয়াচংয়ের বিথঙ্গল আখড়া ও সাগরদিঘি ৫. হবিগঞ্জ সদরের উচাইল-শংকরপাশা শাহী মসজিদ।
বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস রয়েছে এই হবিগঞ্জে। এদের মধ্য খাসিয়া, মনিপুরী ও ত্রিপুরা উল্লেখযোগ্য। বাহুবলের পাহাড়ি এলাকার খাসিয়াপুঞ্জি দেখে নয়ন জুড়াবে যেকোনো পর্যটকের।
হবিগঞ্জের কৃতী সন্তানদের একটি দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। ইতিহাসে স্থান করে নেওয়া এসব ব্যক্তিত্ব ভারতবর্ষের ব্রিটিশ স্বাধীনতা আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গৌরবময় অবদানের জন্য বিখ্যাত হয়েছেন। এ ছাড়া সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে কিংবা অর্থনীতি-রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এসব প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হলেন-
১. সৈয়দ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৮), মধ্যযুগের প্রখ্যাত কবি।
২. শেখ ভানু (১৮৮৯-১৯১৯), প্রখ্যাত সাধক।
৩. বৃন্দাবন চন্দ্র দাশ (১৮৫০-১৯৩২), প্রখ্যাত সমাজ সংস্কারক।
৪. বিপিন চন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২), ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব।
৫. সৈয়দ মুজতবা আলী, (১৯০৪-১৯৭৪) প্রখ্যাত রম্য সাহিত্যিক।
৬. জগৎজ্যোতি দাস (১৯৪৯-১৯৭১), বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের দাস বাহিনীর প্রধান।
৭. শাহ এ এম এস কিবরিয়া, সাবেক অর্থমন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং এসকাপের সাবেক নির্বাহী সচিব।
৮. দেওয়ান ফরিদ গাজী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য।
৯. মেজর জেনারেল এম এ রব, মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড ও সাবেক সংসদ সদস্য।
১০. কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাবেক সংসদ সদস্য।
১১. মেজর জেনারেল (অবঃ) সি আর দত্ত, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সেক্টর কমান্ডার।
১২. সিরাজুল হোসেন খান, সাবেক তথ্যমন্ত্রী, সাবেক শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রী, সাবেক মৎস্য ও প্রানিসম্পদ মন্ত্রী এবং সাবেক সংসদ সদস্য।
১৩. এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য।
১৪. সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন, বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি।
১৫. সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেন, বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি।
১৬. সৈয়দ মোহাম্মদ জোবায়ের, সাবেক সচিব
১৭. সৈয়দ আতাউর রহমান, সাবেক সচিব
১৮. আবদুল মান্নান চৌধুরী (ছানু মিয়া), সাবেক সংসদ সদস্য, ইংল্যান্ডে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।
১৯. ইয়াহিয়া খান চৌধুরী, কুষ্টিয়া ও ঢাকা জেলার প্রথম বাঙালি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য।
২০. জাকারিয়া খান চৌধুরী, কবি, মানবকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক, ভাষা সৈনিক, সাবেক সংসদ সদস্য, জিয়াউর রহমান সরকারের উপদেষ্টা, ইংল্যান্ডে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।
২১. স্যার ফজলে হাসান আবেদ, ব্র্যাক-এর প্রতিষ্ঠাতা।
২২. শেগুফতা বখ্ত চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ও প্রথম কেয়ারটেকার সরকারের উপদেষ্টা।
২৩. ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর।
২৪. শফিকুল হক চৌধুরী. প্রতিষ্ঠাতা- আশা বিশ^বিদ্যালয় ও আশা এনজিও।
বর্ণিত প্রখ্যাত ব্যক্তিগণ স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য দেশের আকাশে নক্ষত্র-তারকারাজির অংশবিশেষ। এছাড়াও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হবিগঞ্জে রয়েছেন, যা আমার কাছে এখনো অজানা।

(চলবে…)