জালাল আহমেদ
আমি এখনো রাষ্ট্রপতির অপরীক্ষিত দই খাওয়া আর মেটাল ডিটেক্টর চেকবিহীন ইলিশের ঝাঁকা’র কথা মনে করি!

১৯৮৭ সালে বর্ষা ছিল দীর্ঘস্থায়ী এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যাও দেখা দেয়। এই বন্যার পানি যখন নামতে থাকে তখন চাঁদপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং নদীভাঙ্গন বেড়ে যায়। বিশেষ করে হাইমচর উপজেলা সদরে ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারন করে। এক শুক্রবারে জেলা প্রশাসক মহোদয় ভাঙ্গন পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখার জন্য যেতে চান। আমরা জেলা পুলের সরকারি লঞ্চ জিএমভি মাইজদী যোগে রওয়ানা হই। প্রশ্ন আসতে পারে যে চাঁদপুর এর লঞ্চের নাম মাইজদী কেনো? এই প্রশ্ন আমার মাথায়ও এসেছিল। মাইজদী কোথায় তাও অনেকে জানেন না হয়তো। আরেকটি প্রশ্ন হতে পারে বাংলাদেশের কোন জেলা সদরে নদী নাই? এ প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি অনেক পরে যখন নোয়াখালীতে চাকুরী করি। নোয়াখালী জেলা সদর ছিল মেঘনা নদীর পাড়ে। ১৯১৯-২০ সালে নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের বাসভবনসহ জেলা সদর ভেঙ্গে যায়, ১৯৪৭-৪৮ এ জেলা প্রশাসকের অফিসও ভেঙ্গে যায়। জেলা সদর স্থানান্তরিত হয় মাইজদীতে।
সেই নামেই এই লঞ্চ। কিন্তু ১৯৫৭ সালের তোহা বাঁধের পর সোনাপুরের দক্ষিণে নতুন করে চর জাগতে শুরু করে আর নদী সরতে থাকে। ফলে লঞ্চ তার প্রাসঙ্গিকতা হারায় আর মাইজদী নামের লঞ্চ ট্রান্সফার হয়ে যায় চাঁদপুর মহকুমায়, পরে জেলায়।
আমরা সকালের মাঝেই পৌঁছে যাই হাইমচর এলাকায়, লঞ্চ নদীর পাড়ের কাছাকাছি যায়। আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় স্মৃতি, এমন অসাধারণ কিছু না, কিন্তু কখনো ভুলি নাই। আমি নদীর দিকে তাকিয়ে দেখি লঞ্চ ও পাড়ের মাঝে নদী জীবন্ত। পানি খলবল করছে, ঢেউ, পাড়ে বারি খেয়ে পাল্টা ঢেউ তুলছে। আমি সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকতে থাকতে নদীর গভীরতা অনুমান করছি। জলতলে ভাঙ্গনের চিত্র কল্পনা করছি আর আমাদের ছোট্ট লঞ্চ এর অসহায়ত্ব দেখছি। একটু পর যখন ফিরে আসছিলাম দেখি জেলেরা ইলিশ ধরছে। লঞ্চ নিয়ে নৌকার কাছে গেলাম, জীবন্ত, কেবল ধরা ইলিশ, সাইজ আড়াই কেজি-পৌনে তিন কেজি, প্রতিটি ২০ টাকা করে। জেলা প্রশাসক ৭টা ইলিশ কিনে ১৫০ টাকা পরিশোধ করলেন। ব্যাচেলর আমিও দুটো ইলিশ কিনলাম। ফিরে এসে খাদ্যে রূপান্তর এর জন্য এডিসি (জেনারেল) মোঃ আফজাল হোসাইন এর বাসায় পাঠিয়ে দিলাম ও দুপুরে জিভে জল আনা স্বাদের ইলিশ পোলাও দিয়ে তার সদগতি হলো।
ঐ সময়েই প্রথমবারের মত বাংলাদেশে মন্ত্রীগণকে বিভিন্ন জেলায় জেলাসমূহের ত্রান ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এই পদ্ধতি বহাল থাকলে ঐসব জেলায় মন্ত্রীদেরকে জেলা মন্ত্রী বলে সম্বোধন করার এক প্রথা দাঁড়িয়ে যায়। বর্তমানে উচ্চ আদালতের আদেশে এই প্রথা রহিত করা হয়েছে। চাঁদপুর জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। আর প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী ছিলেন নীলফামারী জেলার দায়িত্বে। জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী জেলা সফরে আসতেন আর ত্রান ও পুনর্বাসন সমন্বয় সভা করতেন। পরবর্তীতে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভার বিভিন্ন ইস্যুও সেই সভায় আলোচিত হতে শুরু করে। আইন শৃঙ্খলা কমিটির বিষয়াবলী ও অনির্ধারিত ভাবে ঐ সভার আলোচনায় চলে আসে। আমার ব্যাচমেট অমিতাভ চক্রবর্তী তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাবলিক রিলেশন অফিসার (পিআরও) হিসাবে মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে আসতেন। সে সূত্রে মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত জানাশোনা হয়ে যায়। এদিকে এই তিন মন্ত্রীর জেলায় মন্ত্রী হয়ে যায় চারজন। এনডিসি হিসেবে আমার কাজের চাপও বেড়ে যায়।
একদিন বিকেলে ডিসি সাহেবের বাসার চেম্বারে বসে আছি, তখন ৪টা বাজে, ঢাকা থেকে খবর এল যে পরদিন মহামান্য রাষ্ট্রপতি নদী ভাঙ্গন দেখতে আসবেন। একটু পরেই এসপি সাহেব চলে আসলেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সহ আমরা পুরো টিম বসে যাই, রাত ৯টা বাজলো ওখানেই পরদিনের সব প্রস্তুতি নিতে। এর মাঝেই খবর এল যে পরদিন দুপুরে তিনি মধ্যাহ্নভোজ করবেন চাঁদপুরে। সবচেয়ে কঠিন কাজ দাঁড়ালো এতো কম সময়ে মধ্যহ্ন ভোজের ব্যবস্থা করা। রাতেও ব্যস্ততা চলতে লাগলো, পরদিন সকাল থেকেই দমবন্ধ করা ব্যস্ততা। মহামান্য রাষ্ট্রপতি এলেন সম্ভবতঃ ১১টার পর, নামলেন চাঁদপুর স্টেডিয়ামে। এসেই তিনি চলে গেলেন জলপথে নদীভাঙ্গন দেখতে। হেলিকপ্টার এর পাইলটগণ চাইলেন তাঁরা চাঁদপুর নদীমাৎস্য গবেষণা কেন্দ্র দেখবেন। আর তখনই আমি চাকুরী জীবনের এক অন্যতম বড় ভুল করে বসলাম।
আমি নিজে একটা জীপে করে তাঁদের নিয়ে চললাম শহরের বাইরে নদীমাৎস্য গবেষণা কেন্দ্রে। সেখানে গেলাম, তাঁদেরকে ঘুরিয়ে কেন্দ্র দেখালাম। কেন্দ্রের ভেতরে অনেকগুলো পুকুর, একটা পুকুর পাড় ধরে অনেকখানি এগিয়ে দেখা গেল যে ঘুরে আসার পথ নেই, গাড়ি ঘুরাতে হবে। গাড়ি থেকে পাইলটদের নামিয়ে গাড়ি ব্যাক করে পুকুরের পাড়ের ঢালুতে নামিয়ে দিলাম, এরপর তো আর গাড়ি উঠেনা, এক্সিলেটর যতই চাপি, চাকা ঘুরে না। তখন গাড়ি ওখানে রেখেই গবেষনা কেন্দ্রের গাড়ি খুঁজতে লাগলাম। পাইলটদের স্টেডিয়ামে ফিরাতে হবে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্টহাউজে লাঞ্চের ওখানে যেতে হবে, লাঞ্চ প্রস্তুতি তো মিস করলামই। শুক্রবার, কোন ড্রাইভার পাচ্ছি না, সবাই মসজিদে গিয়েছে, ওখানে লোক পাঠিয়ে চাবি সংগ্রহ করে গবেষণা কেন্দ্রের একটা গাড়ি নিয়ে পাইলটদের স্টেডিয়ামে পৌঁছে দিয়ে আমি চলে আসলাম রেস্টহাউজে। পরে জানা গেলো এক্সিলেটর এর কানেক্টিং কর্ড ছিঁড়ে গিয়েছিল।
এসে দেখি রান্না মোটামুটি শেষ, এর মাঝেই মহামান্য রাষ্ট্রপতি এসে পৌঁছালেন, একটু ফ্রেশ হয়েই খাবার টেবিলে। খাবার দেয়া হল, আমি দাঁড়িয়ে, মহামান্য রাষ্ট্রপতি সাচারের বিখ্যাত কই মাছ খাচ্ছেন, হাতে বেছে, পৌরসভার চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন বললেন যে স্যার আমি কাঁটা বেছে দেই? রাষ্ট্রপতি বললেন না, ঠিক আছে, আমিই বেছে নিচ্ছি। চেয়ারম্যানের চাটুকারিতা, “স্যার, দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তো কাঁটা বাছতেছেন!”। একটু পর রাষ্ট্রপতি চাইলেন ডাল, সময়াভাবে ডাল রান্না শেষ হয় নাই! তাই বলা হল। পানিসম্পদ মন্ত্রী উঠে কিচেনের দিকে গেলেন, গিয়ে পেলেন দই, দই দিলেন না কেনো? বললাম যে স্যার, দইটা সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করা হয় নাই। উনি চেয়ে নিয়ে দই খেলেন, কি বিপদ! রাষ্ট্রপতিও টেস্টবিহীন সেই দই চাইলেন, দিতে হল, তিনিও তাই খেলেন।
খাওয়া শেষ হওয়া মাত্র আমি স্টেডিয়ামে, হেলিকপ্টার রেডি করার জন্য। পাইলটরা স্টেডিয়ামে বসেই খেয়েছেন। স্টেডিয়ামে ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ আফজাল হোসেইন, আমরা অপেক্ষা করছি এমন সময়ে প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী পাঠালেন এক বড় ঝাঁকা ইলিশ মাছ, মহামান্য রাষ্ট্রপতির জন্য, এদিকে রাষ্ট্রপতির মোটর কেড এর সাইরেন শোনা যাচ্ছে। এসবি’র মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে চেক ছাড়াই এই ঝাঁকা উঠে গেল হেলিকপ্টারে, এর মাঝেই রাষ্ট্রপতি পৌঁছালেন এবং হেলিকপ্টারে চড়লেন। রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে হেলিকপ্টার আকাশে উড়লো আর আমরা জেলা প্রশাসকের বাংলোতে বসে উদ্বিগ্ন চিত্তে বসে আছি। হেলকপ্টার ঢাকায় ল্যান্ড করার পর আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমার চাকুরী জীবনের এক ভয়ঙ্কর দিন যা আমার এখনো মনে পড়ে। এর একবছর পরে, কথিত মতে এক সন্দেহজনক আমের ঝুড়ি তোলা হয় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক এর বিমানে এবং যুক্তরাস্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও পাকিস্তানের জয়েন্ট চীফ অব স্টাফসহ বিমান দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন। ফলে আমি এখনো সেই অপরীক্ষিত দই খাওয়া আর মেটাল ডিটেক্টর চেকবিহীন ইলিশের ঝাঁকা’র কথা মনে করি!