জালাল আহমেদ
হঠাৎ দেখি দঁড়ি ছিড়ে বোট গেছে হারিয়ে, ওই বোটে ছিলেন ডিসি সাহেব ও তাঁর ছেলে

শীতের বেলা দ্রুত শেষ হয়ে আসছিলো। যখন আমরা হাইমচর ঘাটে পৌঁছাই তখন প্রায় সন্ধ্যা। এসেই একটা লঞ্চ পেলাম যেটা চাঁদপুর ঘাটে যাবে, লোকাল ছোট লঞ্চ। আমরা অনুরোধ করাতে আমাদের নিতে রাজি হল। ঠান্ডা ক্রমশঃ বাড়ছিলো তবুও ডিসি সাহেব লঞ্চে উঠতে রাজি হলেন না। তিনি তাঁর ছেলেসহ বোটে রয়ে গেলেন, বোট দড়ি দিয়ে বাঁধা হল লঞ্চের সঙ্গে। আমি লঞ্চের মাস্টারের কেবিনে। আকাশে হালকা চাঁদের আলো, একটু পর পর আমি মাথা বের করে হালকা কুয়াশার মাঝে বোট দেখি। একবার বাইরে তাকাতেই দেখি পেছনে বোট নাই, দড়ি ছিঁড়ে বোট গিয়েছে হারিয়ে। লঞ্চ ঘুরালাম, ৩০০/৪০০ মিটার পেছনে বোট পাওয়া গেল। লঞ্চের ইঞ্জিনের আওয়াজে বোট থেকে দেয়া চীৎকার কেউ শুনতে পায়নি। এবার আর ছাড় নয়, ডিসি সাহেব এবং তাঁর ছেলেকে লঞ্চে নিয়ে আসলাম। বোটে শুধু বোট ড্রাইভার। চাঁদপুর ঘাটে পৌঁছালাম রাত ১০টায়। এনডিসি সর্দার আলি আজহার ঘাটে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষমান। এটা ছিল আমাদের জন্য অন্যতম একটা খারাপ দিন।
চাঁদপুরে অবস্থানের প্রধান সুবিধাজনক দিক ছিল এর যোগাযোগ ব্যবস্থা। জলপথে ঢাকা যাওয়া ছিল খুবই সুবিধাজনক। বেঙ্গল ওয়াটার ওয়েজ এর লিলি লঞ্চ ছিল অত্যন্ত উঁচু মান সম্পন্ন। দুপুর আড়াইটার এই লঞ্চ বৃহস্পতিবারে ঢাকাগামী যাত্রীভারে টলমল করতো। এখনো চাঁদপুর থেকে ঢাকায় প্রথম ভ্রমনের কথা মনে পড়ে এই লিলি লঞ্চে। এর নাস্তা ছিল অসাধারণ আর মেঘনার রুচিকর হাওয়ায় খিদার উদ্রেক তো হতোই! চট্টগ্রামে যাবার ভালো ট্রেন ছিল মেঘনা, ভোর ৫টায় ছেড়ে গিয়ে সকাল ৯টায় চট্টগ্রাম। আর বিকাল ৫টায় চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে রাত ৯টায় চাঁদপুর। এই ট্রেন মূলতঃ দক্ষিণবংগের লঞ্চযোগে আগত যাত্রীদের চট্টগ্রামে আনা-নেওয়ার জন্য মূল বাহন ছিল। আর সড়কপথে কুমিল্লা হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াততো ছিলই। চাঁদপুর ক্লাব ছিল অত্যন্ত ভালো। বাংলাদেশের মহকুমা পর্যায়ের খুব কম ক্লাবেই বিলিয়ার্ড টেবিল ছিল, চাঁদপুর ছিল তার একটি। ডিসি সাহেব ব্যাডমিন্টন খেলতেন। তাই আমি শুরুতে ডিসি সাহেবের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলে লনটেনিস খেলতে যেতাম। টেনিস খেলার পর একটু রেস্ট নিয়ে স্কোয়াশ, কোন দিন স্কোয়াশ না খেলেই বিলিয়ার্ড। কোনদিন টেবিল টেনিসও খেলা হত। মুশকিল ছিল ক্লাবের কার্ড পার্টিকে নিয়ে। তাঁদের অনেকেই রাতকাবারী খেলতেন। তাঁদের একজন ছিলেন ৮১ ব্যাচের শাহাবউল্লাহ। তিনি অনেক সময়ই ক্লাব থেকেই পরদিন অফিসে যেতেন।
তখন বাংলাদেশে স্যুটিং (রাইফেল স্যুটিং) জনপ্রিয় খেলা। স্যুটিং থেকে দক্ষিন এশিয়া পর্যায়ে, পরে কমনওয়েলথ থেকেও পদক এসেছে। জেলায় জেলায় রাইফেল ক্লাব করার একটা উদ্যোগ নেয়া হয়, চাঁদপুরেও রাইফেল ক্লাব করা হয় যার প্রথম সাধারন সম্পাদক হই আমি। এর গঠনতন্ত্রও আমার করা। চাঁদপুর জেলায় কোন চাঁদমারি ছিল না, পুলিশের ফায়ারিং প্র্যাকটিস করতে কুমিল্লা যেতে হত। ১৬ ডিসেম্বরে খেলাধুলায় ১০ মিটার এয়ার রাইফেল স্যুটিং একটা আইটেম রাখা হল। স্যুটিং ফেডারেশন থেকে আনা টার্গেট পেপার, স্থানীয়ভাবে বানানো টার্গেট স্ট্যান্ডে লাগিয়ে নানুপুর স্লুইচ গেটের উঁচু বাঁধকে পেছনে রেখে আমরা চাঁদপুর জেলায় রাইফেল ক্লাবের প্রথম কার্যক্রম করি। পরে ১৯৮৭ সালে সপ্তম ইন্টার ক্লাব স্যুটিং এ চট্টগ্রাম দামপাড়া মেট্রোপলিটন পুলিশ লাইনে আমি ও বদরুদ্দোজা শাহাবউল্লা ভাইয়ের নেতৃত্বে অংশ নেই। ১৯৮৮ সালে অষ্টম ইন্টার ক্লাব স্যুটিং এ ন্যাশনাল স্যুটিং রেঞ্জ, ঢাকায়, আমি চাঁদপুর রাইফেল ক্লাবের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করি।
ডিসেম্বর মাসেই আমার বদলীর আদেশ হয় উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পুনরায় ফরিদ্গঞ্জ উপজেলায়। এখন জেলা প্রশাসক মহোদয় আমাকে ছাড়বেন না। এ নিয়ে তিনি একাধিকবার কমিশনার মহোদয়ের সঙ্গে কথা বললেন। কমিশনার সব শেষে বললেন যে সে পার্বত্য জেলায় উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ করেছে, তাঁর ম্যাজিস্ট্রেসী শিক্ষা যথাযথ হয় নাই, এই পোস্টিং তাঁর প্রয়োজন তবে তাঁকে ৪ মাস পরে আবার চাঁদপুর ফিরিয়ে নিয়ে আসব। এই কথার পর আর কথা থাকে না। এদিকে ফরিদ্গঞ্জের উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল বারেক ওখানে থাকবেন, মন্ত্রী মওলানা মান্নান তাঁকে রাখবেন এসব বলা হচ্ছে। তাঁকে স্টেশনেও পাওয়া যাচ্ছে না। জেলা প্রশাসক বললেন তুমি চলে যাও। আমি ১৯৮৭ সালের জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে ফরিদ্গঞ্জ যাই এবং দু’দিন অপেক্ষা করে জেলা প্রশাসকের সম্মতি নিয়ে ৭ জানুয়ারী উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর দায়িত্বভার এজিউম করে কাজ শুরু করি।
ফরিদ্গঞ্জ উপজেলায় তখন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল মতিন এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার ১৯৮১ ব্যাচের শাহ মোকসেদ আলী। ফরিদ্গঞ্জ যেতে তখন দু’টো ফেরী, একটা চাঁদপুরের কাছে ইচলী ঘাটা আরেকটা ফরিদ্গঞ্জ ঘাট, দুই ফেরির মাঝের অংশে ৮ মাইল রাস্তা কাঁচা। ফরিদ্গঞ্জ ঘাটের পাশেই জেলা পরিষদ এর ডাকবাংলো, সেখানেই উঠলাম। কয়েকদিন ওখানে থেকে উপজেলা পরিষদ এর কাছে পানি উন্নয়ন বোর্ড কম্পাউন্ডে তাদের রেস্টহাউজে চলে যাই। আমি সাধারনতঃ নতুন কোন জায়গায় যাবার আগে সেই জায়গা সম্পর্কে পাওয়া যায় এমন সকল তথ্য জেনে যাবার চেষ্টা করি। ছাপানো যা আছে তা পড়ে যাবার চেষ্টা করি, যাবার পর মিলিয়ে দেখারও চেষ্টা করি। ফরিদ্গঞ্জে গিয়েও শিক্ষা অফিসারের মোটর সাইকেল নিয়ে পুরো উপজেলা ঘুরতে শুরু করলাম। বিশেষ করে লোহাগড়ার মঠ, সাহেবগঞ্জ এর নীলকুঠি এবং যেদিকে যাই সেদিকেই ডাকাতিয়া আমাকে চমৎকৃত করে।
এভাবেই ৫/৬ দিন পর একদিন গেলাম রুপসা বাজারে, সেখানে একটি হাই স্কুল আছে, রূপসা আহমদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়। বাজারের একপাশে একটি পুরনো তোরন, পাশে একটি প্রাচীন মসজিদ, রুপসা জমিদার বাড়ি। ভেতরে গেলাম, বাড়ির অনেক খানি আঙ্গিনায় মোটরসাইকেল থামিয়ে দাঁড়ালাম। ভেতরে বিশাল এক আংগিনায় কিছুক্ষণ পর বাজারের দিক থেকে ক্রস করে চাদর গায়ে এক ভদ্রলোক এসে হাজির, সঙ্গে আরো ১০/১২ জন। এসেই আমাকে বড়িতে বসতে বললেন। আমি রাজি হচ্ছিলাম না, তিনি বললেন এটা এই বাড়ির ইজ্জতেরও প্রশ্ন। আমি জিজ্ঞেস করলাম আমাকে চেনেন? বললেন আপনি আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। তখন বুঝলাম অচেনা হয়ে বেড়ানোর ইতি হল। বসলাম, দ্রুত চমৎকার সাহেবী নাস্তা চলে এল, বুঝা গেল যে তারা অভ্যস্ত।
রূপসা জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা আহমদ গাজী-মাহমুদ গাজী দুই ভাই, পুত্র সন্তান না থাকায় হবিগঞ্জ এর সৈয়দ হাবিব উল্লাহ তাঁদের মেয়ে বিয়ে করে এখানে চলে আসেন। বংশের সবচেয়ে নামকরা ব্যক্তি সৈয়দ আব্দুর রশিদ চৌধুরী ভাইসরয় এর এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল এর সদস্য ছিলেন। পাইকপাড়া’র গুহ উপাধিধারী জমিদারদের সঙ্গে বসলেন হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য। কথায় না বনাতে উঠে চলে আসলেন, পাইকপাড়া হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হলো ১২ জানুয়ারী ১৯১৩ সালে। পরদিন ১৩ জানুয়ারী প্রতিষ্ঠিত হল রূপসা আহমদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়। দুই জমিদারের মতানৈক্যে এক উপজেলা ১৯১৩ সালে দু’টি হাইস্কুল পেয়ে গেল। বর্তমান চাঁদপুর শহরের অনেকখানি ছিল তাঁদের জমিদারীভুক্ত। চাঁদপুর শহরের বেগম মসজিদও এই পরিবারের স্থাপন করা। সৈয়দ আব্দুর রশিদ চৌধুরীর ৬ কন্যা ও ২ পুত্র বৈবাহিক সুত্রে বাংলাদেশে ও ভারতের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পরিবারের সঙ্গে যুক্ত। এই পরিবারেরই সৈয়দ আবিদুর রেজা ২৮ বছর কুমিল্লা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন আর কুমিল্লা জেলা জুড়ে জেলা পরিষদের বিভিন্ন রাস্তায় উটের কুজের মত অসংখ্য সেতু বানিয়েছিলেন।