জালাল আহমেদ
জেলায় কাজ আগে ফাইল পরে আর সচিবালয়ে ফাইল আগে কাজ পরে
সভায় দেখলাম লেঃ কর্ণেল আরেফুর রহমানসহ সকল সিও এসপি মোয়াজ্জেম হোসেন খানকে স্যার এড্রেস করছে। এর রহস্য পরে জানলাম

আনুষ্ঠানিকভাবে জেলার কাজ শুরু হলো। মহকুমা প্রশাসনে এনডিসি ছিলাম, ১ নভেম্বর থেকে জেলার নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি)’র কাজ করছি। জেলা উদ্বোধনের পর জেলায় এনডিসি পদে পদায়নের স্থানীয় আদেশ হলো। একাধিকবার আমার এমন হয়েছে যে যথাযথ আদেশ ছাড়াই কাজ করছি, আনুষ্ঠানিক আদেশ পরে হয়েছে। যেমন এক্ষেত্রে আমার মূল পদায়ন মহকুমায়, খাগড়াছড়ি জেলা সদরে আমার কোন পোস্টিং কখনো হয় নাই। আমি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সচিবালয়ের পার্থক্য বুঝাতে অনেক সময়ই এটা বলতাম যে, জেলায় কাজ আগে, ফাইল পরে। আর সচিবালয়ে ফাইল আগে, কাজ পরে। ব্যতিক্রমও অবশ্য আছে তবে তা’ নিয়মকেই প্রতিষ্ঠিত করে।
জেলার জন্ম হলো কিন্তু তখনো এক থানার মহকুমা রয়ে গেছে, সারাদেশে ৬৮ মহকুমা প্রশাসকও বহাল। মহকুমা প্রশাসকও এক কল্পিত মহকুমায় কাজ করছেন কারণ সদর থানার অনেক কাজইতো সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) আশরাফুল আলম করছেন। তাঁকে পরেও উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পেয়েছি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায়। মহকুমার সকল স্টাফও জেলায় কাজ করছিল, মহকুমা অফিসের শাখাগুলো জেলা প্রশাসকের দপ্তরের শাখা হয়ে গেলো। জেলা হবার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিগেড কমান্ডারেরও উন্নতি হলো, তিনি হলেন সাব-জোনাল মার্শাল’ল এডমিনিস্ট্রেটর-২০, আর আমি হলাম সিভিল লিয়াজোঁ অফিসার টু এসজেডেমএলএ-২০। একই সময়ে তাঁর ভাই কমোডোর মোহাইমিনুল ইসলাম (পরে নৌবাহিনী প্রধান ছিলেন) চট্টগ্রাম বন্দরসহ কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড় এলাকার জন্য সাব-জোনাল মার্শাল’ল এডমিনিস্ট্রেটর-৮ ছিলেন।
সেপ্টেম্বর মাসেই আমাকে এক মার্শাল’ল কোর্ট অব ইনকোয়ারীতে মহালছড়ি যেতে হয় সদস্য হিসেবে। কোর্ট অব ইনকোয়ারী’র প্রেসিডেন্ট ছিলেন ৩৬ ইস্টবেঙ্গল এর ২আইসি (সেকেন্ড ইন কমান্ড) মেজর হাসান। চট্টগ্রামের লোক, সিনিয়র মেজর। অভিযোগ ছিল ইউএনও মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে, তিনি ১৯৭৩ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা। অভিযোগ করেছেন এপিবিএন কমান্ডিং অফিসার। হাস্যকর এক অভিযোগ ছিল যা এখানে উল্লেখ করছি না। তবে বিষয়টি স্পর্শকাতর আর আমি ১৯৮২ ব্যাচের এক কনিষ্ঠ কর্মকর্তা তদন্ত দলের একজন। আমরা প্রটেকশনসহ জীপে কমলছড়ি বা মাইছছড়ি যেয়ে বোটে উঠে মহালছড়ি যাই। তখন সারাদেশে এপিবিএন এর ৮টি ব্যাটালিয়নের মধ্যে ৫/৬টি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশন ডিউটিতে। ঐদিন ডিআইজি এপিবিএন হাদিস উদ্দিনও (পরে অল্প সময়ের জন্য আইজি) এসেছিলেন ইউনিট ভিজিটে। ডিআইজি থাকায় আমাদের ইনকোয়ারী আসলে সহজ হয়ে গেলো। আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করলাম, ইউএনও এবং সিও এপিবিএন, দু’জনেই ৭৩ ব্যাচ, দু’জনকেই প্রয়োজনীয় ব্রীফ করার পর ফিরে আসলাম।
অক্টোবর মাসে সম্ভবতঃ দ্বিতীয় সমন্বয় সভায় যোগ দিতে এলেন এসপি রাঙ্গামাটি জনাব মোয়াজ্জেম হোসেন খান। দেখলাম যে ব্যাটালিয়ন কমান্ডারদের মধ্যে সিনিয়র মোস্ট ৩৬ ইস্টবেংগলের লেঃ কর্ণেল আরেফুর রহমানসহ সকল সিও তাঁকে স্যার এড্রেস করছে। আমি অবাক হলাম। পরে সিও ৩৬ বেংগলকে কারণ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন যে এসপি প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা এবং সেনাবহিনীতে তাঁদের সিনিয়র ছিলেন, তাই। পরে জানতে পারি যে জেনারেল জিয়া, সম্ভবতঃ পুলিশ বাহিনীর উপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য অথবা প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রাক্তন পিএসপি কর্মকর্তা না থাকায় ২১ জন সেনা কর্মকর্তাকে পুলিশে আত্মীকৃত করেন। তাঁদের মধ্যে অন্ততঃ তিনজন পরে পুলিশের মহাপরিদর্শকও হয়েছিলেন।
আরেকদিন যেতে হলো পানছড়ি উপজেলায়, কেন গিয়েছিলাম তা’ এখন আর মনে নেই। খাগড়াছড়ি মহকুমা উপজেলা হয়ে যাওয়ায় এসডিও ছমিরউদ্দিন সাহেব ইউএনও সদর হয়ে গিয়েছেন ও ৪ ডিসেম্বর যোগদান করেছেন। এরপর সারাদেশেই মহকুমা প্রশাসন ধাপটি বিলুপ্ত হয়, যে পদ এবং পদধারীকে দেখে সিভিল সার্ভিসে আসার স্বপ্ন দেখেছিলাম সে পদও বিলুপ্ত। এসডিও সাহেবের পুরনো জীপ তখন ডিসি অফিসে, সেই জীপ নিয়ে গেলাম। খাগড়াছড়ি-পানছড়ির ২৪/২৫ কিলোমিটার রাস্তা’র পুরোটাই তখন কাঁচা। পুরো রাস্তাই চেংগী ভ্যালী ধরে, নদীর ধার ঘেঁষে। রাস্তার পশ্চিম পাশে নদী, কখনো ৫০ মিটার দূরে কখনো ৫০০ মিটার, রাস্তা গিয়েছে সোজা উত্তরে। পূর্ব পাশ থেকে ছড়াগুলো রাস্তা পার হয়ে নদীতে পড়েছে। অধিকাংশ বা সব ছড়ার উপরেই কাঠের পুল।
খাগড়াছড়ি বাজার চৌরাস্তা পার হয়ে ডানে মোড় নিয়ে উত্তরমুখী যাত্রা শুরু। মহাজন পাড়া পার হয়ে সদর উপজেলা খেজুরবাগান এলাকায়, এরপর পেরাছড়া, সেখানে একটা হাইস্কুল ছিল। মাঝপথে ভাইবোনছড়া, ছড়ি নয় কিন্তু! ভাইবোনছড়াতে বাজার, একটি বড় সেনাক্যাম্প ও একটি স্কুল ছিল। আরো কিছুদূর যাবার পর নালকাটা যেখানে সেখানে আর একটি সেনা ক্যাম্প হয়েছিল। নালকাটার পর পানছড়ির প্রথম ইউনিয়ন লতিবান, ছড়ার নামও লতিবান ছড়া। লতিবান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন চন্দ্রনাথ চাকমা। তারপর কিছুদূর গেলে হাতের বামে, রাস্তার পশ্চিম পাশে নদীর পাড়ে পানছড়ি বাজার। বাজার, ফুড গোডাউন, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, থানা পার হলে পর রাস্তার পূর্ব পাশে কোর্ট বিল্ডিং (তখনো নির্মাণাধীন), তারপর রাস্তার পশ্চিম পাশে উপজেলা পরিষদ।
উপজেলা পরিষদের সামনে গিয়ে নামতেই ইউএনও রফিক উদ্দিন মোল্লা সাহেব বের হয়ে এলেন সঙ্গে গামছা হাতে এক পিয়ন, বিপুল! পরিষদের সামনেই বিপুল আমাকে গামছা দিয়ে ঝাড়তে শুরু করলো আর আমার সারা শরীর থেকে সাদা ধুলা উড়তে লাগলো। কোত্থেকে যে এই সূক্ষ ধুলো গাড়ির ভেতরে ঢুকলো আমি টেরও পাইনি। শীতকালে পানছড়ির এই গামছা অভ্যর্থনা খুবই পরিচিত একটা বিষয় ছিল। প্রাক্তন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রাক্তন জেলা প্রশাসক, পার্বত্য চট্টগ্রাম, মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান ১৯৬২ সালে কাপ্তাই রোড এর অভিজ্ঞতায় বলেছেন, “ল্যান্ডরোভার থেকে নেমে দেখি পথের ধূলায় আমার কালো স্যুট আর কালো চুল ধূসর হয়ে গেছে-চোখের ভুরুগুলো পর্যন্ত সাদা”। পানছড়িতেই গল্প শুনলাম ব্রিগেড কমান্ডার কর্তৃক উপজেলা কৃষি অফিসারকে পরিষদ প্রঙ্গণে ব্যাটন দিয়ে গুতানোর কথা, যার পরিপ্রেক্ষিতে ঐ ভদ্রলোক চাকুরী ছেড়ে পানছড়ি থেকে চলে যান। পানছড়িতে আমার প্রথম সফর কিন্তু তখনো জানতাম না যে ভবিষ্যতে এখানে আমাকে কাজ করতে হবে। ঐদিনের কাজ সেরে বিকেলের মধ্যে রুট প্রটেকশন থাকা অবস্থায় খাগড়াছড়ি ফিরে এলাম।