জালাল আহমেদ
সেনা প্রহারায় গৃহবন্দী মওলানা ভাসানীর কাছে গিয়ে সালাম দিয়েছি আর জন্মদিনে কথা বলেছি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে

ঢাকায় ফিরে কয়েকদিন পর ইচ্ছে হলো মৌলানা ভাসানীকে দেখতে যাবো। আমার হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই ক্লাসমেট এস ফুয়াদ পাশা ও আব্দুল্লাহ আল ফারুকের বাবা তখন টাঙ্গাইলে পোস্টেড। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একদিন প্রগতির সংযোজিত স্টিলবডি বাসে (এই বাস দীর্ঘদিন নারায়ণগঞ্জ-মোহাম্মদপুর রুটে চলেছে) করে টাঙ্গাইল রওয়ানা হলাম। ঢাকা-টাঙ্গাইল রোডে তখন অসংখ্য সরু লোহার ব্রিজ। বর্তমান ঢাকা-ময়মনসিংহ রোড তখন ছিল না। সব গাড়িই টাঙ্গাইল হয়ে (টাঙ্গাইল ৬০ মাইল আর মধুপুর ৯০ মাইল পার হয়ে) ১২০ মাইল দূরের ময়মনসিংহ যেতো। টাঙ্গাইলে পৌঁছে বন্ধুর বাসা খুঁজে বের করলাম, সরকারী কোয়ার্টার, নীচে অফিস ও উপরে বাসা। দুজনেই আমাকে পেয়ে খুব খুশি। তাদের বাবা মাও একইভাবে খুশি। তার বাবা জনাব মোস্তফা মিয়া আমার বড় চাচার ক্লাসমেট ছিলেন এবং ডাক বিভাগে পোস্টমাস্টার জেনারেল হয়ে অবসরে যান।
পরদিন গেলাম টাঙ্গাইল শহরের অদূরে সন্তোষ, মওলানার বাড়ি, আসলে সন্তোষের মহারাজার বাড়ি। ভারতের জাতীয় ফুটবল ট্রফি’র নাম সন্তোষ ট্রফি, কারণ সে ট্রফির দাতা ছিলেন সন্তোষের মহারাজা। এটা অবাক করা যে অবিভক্ত ভারতে ৬০২টি দেশীয় রাজ্য ছিল যার একটিও বর্তমান বাংলাদেশের সীমানাভুক্ত নয়। তাঁদের কেউ ট্রফি দিলেন না, দিলেন তৎকালীন বাংলার এক জমিদার। মহারাজার বাড়ির আঙ্গিনায় পৌঁছার পর স্বভাবতই কোন দালানে আমি মৌলানাকে দেখব বলে আশা করছিলাম। জিজ্ঞেস করে করে এক টিনশেড, বাঁশ-কাঠের বেড়ার ঘরের কাছে পৌঁছালাম। বাড়ির চারিদিকে সেনা প্রহরা, সেনাবাহিনীর তাঁবু। মওলানা তখন নিজ বাড়িতে অন্তরীন বা গৃহবন্দী। আমাকে আটকানো হলো, জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁরা নিশ্চিত হলো যে আমি নিতান্তই নিরাপদ এক উৎসুক কিশোর, তখন তাঁরা আমাকে মওলানার ঘরের কাছে যাবার অনুমতি দিলো। সময়টা দুপুর, মওলানা ভাসানী খেতে বসবেন। ছবিতে যেমন দেখা যায় তেমনি এক ভাঙ্গা ঘরের জানালা দিয়ে আমি উঁকি দিলাম, দেখি আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, আসামের লাইনপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের নেতা মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একটি পাটিতে বসে নিজেই খাবার নিয়ে খাচ্ছেন।
তিনি ১৯৫৭ তে যেমন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠিকে আসসালামু আলাইকুম বলে বিদায়ের বার্তা দিয়েছিলেন তেমনি ৭০ এর ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকা ঘুরে এসে বলেছিলেন ‘ওরা আসে নাই’। ১৯৭১ মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন। তিনি ছিলেন পীর, মুরিদান ছিল তাঁর। আবার বামঘেঁষা হিসেবে ‘রেড মৌলানা’ হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। তবে, কি এক অজ্ঞাত কারণে কখনো ক্ষমতা ঘেঁষা ছিলেন না। আমি সালাম দিলাম, পরিচয় দিলাম এবং এই মহান নেতাকে দেখার তৃপ্তি নিয়ে সরে আসলাম।
তারপর আরো দু’দিন থাকলাম টাঙ্গাইলে। ২৬ জুন সকালে ইত্তেফাক পড়তে গিয়ে দেখি ঐদিন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর জন্মদিন, ১১ জ্যৈষ্ঠ, দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে, বিদায় নিয়ে সেই প্রগতির বাসে চড়ে ঢাকা রওয়ানা হলাম, বিকেলের দিকে বাস আমাকে পিজি’র সামনে (বর্তমান বিএসএমএমইউ) নামিয়ে দিলো। পিজির বি ব্লকে ৪ বা ৫ তলায় কবিকে রাখা হয়েছিল। আনুষ্ঠানিকতা বা ভিজিটর হয়তো সকালেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, তখন ফ্লোর ফাঁকা। আমি যখন উদ্দিষ্ট কেবিনে গিয়ে পৌঁছালাম কোন ডিউটি নার্সও তখন সেখানে ছিল না। আমি জাতীয় কবি’র কেবিনে ঢুকলাম, দেখলাম, নিজেই কথা বললাম, আমরা জানি যে উনার সঙ্গে বাক্য বিনিময় সম্ভব ছিল না। তার কিছুদিন পরই মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মারা যান। আমার সৌভাগ্য যে আমি কাছ থেকে তাঁদের দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম নইলে পরে আর কোন সুযোগ হতো না।
এর মাঝে জুলাই মাস এলো, ভরা বর্ষা, বৃষ্টি বাদলের ঘনঘটা। তখন ঢাকা থেকে ট্রেনে গেলাম চট্টগ্রাম, সেখানে আমার এক মামা ছিলেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী। চট্টগ্রামে জনস্বাস্থ্য বিভাগের অফিস রহমতগঞ্জে, কাছেই পিডাব্লিউডি অফিস। সেটার নাম সিএন্ডবি (কনস্ট্রাকশন এন্ড বিল্ডিং) থাকাকালে আমার আব্বা ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত সেখানে চাকরি করেছেন। ছোটবেলায় আমরা থাকতাম দেওয়ান বাজার সিএন্ডবি কলোনীতে। চট্টগ্রামের বর্ষা বিখ্যাত একটানা অঝোর ধারায় বর্ষণের জন্য, তখনো কয়েকদিন চললো তুমুল বর্ষণ। যারা চট্টগ্রামের তারা জানেন দক্ষিণ চট্টগ্রামে এ সময় কেমন বন্যা হয়। ১৯৭৬ সালেও সব ডুবে গিয়েছিল, সমস্ত টিউবওয়েল এবং পানীয় জলের পুকুর ডুবে যাওয়াতে চারিদিকে পানীয় জলের অভাব। সিদ্ধান্ত হলো জনস্বাস্থ্য বিভাগের বড় গাড়িতে করে দুর্গত এলাকায় পানীয় জল পাঠানো হবে। বড় ট্রাকে দুটো স্টীল ট্যাংক বসিয়ে জিইসি মোড় থেকে পানি ভর্তি করে ট্রাকের সঙ্গে আমিও গেলাম বন্যাদুর্গত মানুষকে পানীয় জল পৌঁছে দিতে। পটিয়া পর্যন্ত পৌঁছুতে পারিনি, তার আগেই পথে পথে গাড়ি থামাতে হয়েছে বারবার আর মানুষ হাড়ি-পাতিল নিয়ে সাঁতরে এসেছে পানীয় জলের জন্য। পরে এই ট্রাক পানীয় জল নিয়ে আরো এমন অনেক ট্রিপ দিয়েছিল।
এরপর গেলাম রাঙ্গামাটি। ছোটবেলায় যখন চট্টগ্রামে ছিলাম তখন ১৯৬৭ সালে কাপ্তাই যাওয়া হলেও রাঙ্গামাটি যাওয়া হয়নি। তাই একটা আকর্ষণ ছিল। ভারী বৃষ্টিতে পাহাড় ধ্বসে রাঙ্গামাটির রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অপেক্ষা করে করে সাতদিন পর যেদিন রাস্তা খুললো সেদিনই জনস্বাস্থ্যের ফিল্টারবাহী একটা পিকআপে চড়ে আমি রাঙ্গামাটি রওনা হলাম। পথে ঘাগড়ার কাছে তখনো সড়ক বিভাগের বুলডোজার আর পে-লোডার/এক্সক্যাভেটর রাস্তা খুলতে কাজ করে যাচ্ছে। ঐদিন রাঙ্গামাটিতে যে ক’টা গাড়ি প্রথম প্রবেশ করেছে তাঁর মধ্যে আমরাও ছিলাম। রাঙ্গামাটি লেক তখন কানায় কানায় পরিপূর্ণ। রাস্তা বন্ধ থাকায় কৃষি পণ্য জলের দর, আনারস কিনলাম টাকায় সাতটা, মাঝারী কাঁঠাল এক টাকা করে। দুপুরে খেলাম লেকপাড়ে একটা রেস্তোরাঁতে, বাছা মাছ দিয়ে, এমন অসাধারণ বাছা হাওর ছাড়া আর কোথাও কখনো খাইনি। এরপর সন্ধ্যায় ফিরে আসলাম চট্টগ্রাম।
একদিকে আমার বেড়ানোর সময় শেষ হয়ে আসছিল অন্যদিকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের সময়ও এগিয়ে আসছিল। তাই একদিন জনস্বাস্থ্যের ফিল্টারবাহী পিকআপে করে চট্টগ্রাম থেকে হবিগঞ্জ রওয়ানা দিলাম। সেদিনও তুমুল বৃষ্টির দিন ছিল আর রাস্তা ছিল খারাপ, বিশেষ করে কুমিল্লার পর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছাতেই রাত ৯টা পার হলো, তখন হবিগঞ্জের রাস্তা এন২ ছিল তেলিয়াপাড়া হয়ে চা বাগানের ভেতর দিয়ে। ডাকাতের ভয় ছিল তাই ড্রাইভার সরকারী মালসামান নিয়ে আর যেতে সাহস করলো না। আমার অনিচ্ছা থাকলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জনস্বাস্থ্য বিভাগে আমরা রাত্রিযাপন করলাম। রাতে আর কর্তৃপক্ষের কাউকে বিরক্ত না করে রাস্তার পাশে কর্মচারীদের আবাসে আমাকে একটা বিছানা ছেড়ে দেয়া হল। বিছানায় যেমন ছাড়পোকা ছেঁড়া মশারীর ভেতর তার চেয়ে বেশি মশা। রাত তিনটায় উঠে রাস্তার পাশে বসে রইলাম। এটাই তখন ঢাকা-সিলেট বা চট্টগ্রাম-সিলেট মহাসড়ক। মাঝেমাঝে হুশ হাশ করে একটা দুটো ট্রাক চলে যাচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখের রাতও পোহায়, সে রাতও শেষ হলো। ভোরবেলা আবার যাত্রা শুরু করে সকালের মাঝেই হবিগঞ্জে পৌঁছে যাই।