মন্তব্য প্রতিবেদন
ডা. মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাব

১৯৭৪/৭৫ সনে সিলেট সরকারি কলেজ (এমসি কলেজ) ছাত্রাবাসে আমার দুই বছর থাকার সৌভাগ্য হয়। ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত বৃটিশ আমলে আসাম প্রদেশে সিলেট এমসি কলেজ ছিল অত্রাঞ্চলের এক দ্বীপ্ত আলোক বর্তিকা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলের প্রারম্ভিক পর্যায়েরও এই রতœগর্ভা প্রতিষ্ঠানের বিচ্ছুরিত আলো বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে আলোকিত করে আসছিল। বিশাল ক্যাম্পাস, দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ, সুবিশাল এলাকা নিয়ে পাঁচটি ব্লক সহ অভিজাত ছাত্রাবাস, এর অভ্যন্তরে শান বাঁধানো ঘাট সম্বলিত বিশাল পুকুর, ছাত্রাবাসের সম্মুখে সুবিশাল খেলার মাঠ, সারি সারি পামট্রি সমগ্র অঞ্চলটাকে একমোহনীয় আবেশে আচ্ছন্ন করে রেখে আসছে যুগ যুগ ধরে।
এমসি কলেজের বহু প্রাক্তন শিক্ষার্থী আজ দেশ-বিদেশে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, প্রশাসনিক ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন সেক্টরে সুনামের সহিত কর্মরত ছিলেন ও আছেন তা বলাই বাহুল্য।
তৎকালীন সময়ে ছাত্রাবাস সুপারদের কড়া নজরদারি ও স্নেহমমতায় পড়াশোনার পরিবেশ ছিল চোখে পড়ার মত। আমরা ভর্তি হয়ে শুনেছি তিন যুগেরও অধিককাল জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান দাপুটে অধ্যক্ষ অধ্যাপক জনাব সোলেমান চৌধুরী উনার কড়া শাসন, ব্যক্তিত্ব ও বিশেষ মমতায় এমসি কলেজের মান ও সম্মানকে অনন্য এক উচ্চতায় উন্নীত করেছিলেন। এমন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ নান্দনিক পরিবেশ সম্বলিত ছাত্রাবাসের একজন প্রাক্তন ছাত্র হতে পেরে নিজেকে অনেকটা গৌরবান্বিতই মনে করতাম।
অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম বছর কয়েক পূর্বে যখন শুনেছিলাম ছাত্র রাজনীতির জের ধরে আমার কৈশোরের স্মৃতি সম্বলিত ছাত্রাবাসের ৩নম্বর ব্লককে একদিন সন্ত্রাসী একদল ছাত্ররা সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে ফেলে। জানিনা এ ঘৃন্যতম অপরাধের বিচার আজো কোন আলোর মুখ দেখেছে কি না।
আজ ভীষণ মর্মাহত এবং চরম লজ্জিত হলাম যখন জানলাম করোনার ছুটিকালীন সময়ে হোস্টেলে ঘুরতে আসা এক দম্পতিকে জোরপূর্বক আটক করে হোস্টেলের কয়েকজন ছাত্র স্বামীকে বেঁধে রেখে উনার উপস্থিতিতেই উনার স্ত্রীকে অস্ত্রের মুখে গণধর্ষণ করে। এমসি কলেজের হোস্টেল ইতিহাসে এমন কলঙ্কময় চরম ঘৃণ্যতম ঘটনা আর কখনো ঘটেছে বলে আমার জানা নাই।
শতবর্ষীয়ান এমন একটা স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তার ছাত্রাবাস আজ ধর্ষণের কালিমায় কলঙ্কিত হল যা ইতিহাসের পাতায় এক জঘন্যতম ঘটনা হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে অনাদিকাল।
দুর্বল, চাটুকার, অযোগ্য, পদলেহী কলেজ প্রশাসনের নাকের ডগায় কেমন করে বৈশ্বিক মহামারিতে কলেজের ছাত্রাবাস খোলা থাকে এবং ছুটিকালীন এ সময়ে কেমন করে অস্ত্রধারী ছাত্ররা অবস্থান করে তা অবশ্যই জাতির সম্মুখে এক বিরাট প্রশ্ন। নীতি নৈতিকতায় এমন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকের অবস্থান আজ কোথায় নেমে এসেছে তাও জিজ্ঞাস্য।
ধর্ষণ ঘটনায় ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসী গুন্ডারাই কেবল নয়, তৎসঙ্গে কলেজের শিক্ষক-প্রশাসনও সমানভাবে দায়ী। এ সিনারিও শুধু সিলেট নয় বরং সমগ্র দেশের আইনের শাসনের অবক্ষয় এবং দুর্বলতার প্রতিফলনও বটে।
বিবেকের তাড়নায় প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক যে এত্থেকে পরিত্রাণের এ মুহূর্তে উপায় কি? প্রতিকারই বা কি?
আমাদের পরবর্তী উত্তরসূরি বা প্রজন্মের ভবিষ্যতই বা কি?