অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য নিষ্কাশনের কারণে চরম সঙ্কটে পতিত হবিগঞ্জের নদী-খাল-বিল জলাশয়
শিল্পবর্জ্য দূষণের কারণে মারা যাচ্ছে গবাদিপশু হাঁস-মুরগি। মৎস্যশূন্য হয়ে পড়ছে নদী-খাল-বিল জলাশয়। অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে শ^াসকষ্ট, চর্মরোগসহ জটিল রোগে। অসহনীয় দুর্গন্ধের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন লাখো মানুষ
স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জ জেলায় অপরিকল্পিত গড়ে ওঠা কলকারখানার অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য নিষ্কাশনের কারণে চরম সঙ্কটে পতিত হয়েছে নদী-খাল-বিল জলাশয়। বর্জ্য নিষ্কাশনের কারণে পাশর্^বর্তী গ্রামগুলোর লাখো মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে নদী পাড়ের মানুষ। কয়েক বছর ধরে চলে আসা শিল্পবর্জ্য দূষণের কারণে মারা যাচ্ছে গবাদিপশু হাঁস-মুরগি। মৎস্য শূন্য হয়ে পড়ছে নদী-খাল-বিল জলাশয়। অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে শ^াসকষ্ট, চর্মরোগসহ জটিল রুগে। অসহনীয় দুর্গন্ধের ভেতর দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছেন লাখো মানুষ। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী দায়ী করছে কল-কারখানার মালিক ও দূষণরোধে দায়িত্বশীলদের।
১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস উপলক্ষে ১৩ মার্চ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা হবিগঞ্জ শাখা ও খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার শিল্পবর্জ্যে দূষণে চরম আক্রান্ত সুতাং নদী ও তদসংলগ্ন খালগুলো পরিদর্শনে যান।
বাপা জেলা সেক্রেটারী ও খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেলের নেতৃত্বে পরিদর্শনে অংশগ্রহণ করেন বাপা আজীবন সদস্য এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল, লাখাই উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ আমিরুল ইসলাম আলম, বাপা সদস্য অ্যাডভোকেট বিজন বিহারী দাস, সাংবাদিক ও আইনজীবী শাহ ফখরুজ্জামান, নদীকর্মী ডা: আলী আহসান চৌধুরী পিন্টু, মোঃ আমিনুল ইসলাম, মোঃ আবিদুর রহমান রাকিব, সাইফুল ইসলাম, মেহের সাগর সোহাগ প্রমুখ। এসময় তারা করাব, ছড়িপুর, উচাইল, রাজিউড়া, সাধুর বাজার, মির্জাপুর, ঘোড়াইল চর, আব্দুর রহিমপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন এবং শিল্পবর্জ্য দূষণে আক্রান্ত গ্রামবাসীর কথা শুনেন।
পরিদর্শনকালে তারা দেখতে পান সীমান্ত অতিক্রমকারী সুতাং নদীর পানি কালো কুচকুচে হয়ে আছে। পানি থেকে চরম দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। নদীর দূষিত পানিতে মরে আছে জলজ প্রাণী।
উচাইল গ্রামের আব্দুস সালাম (৮০) বলেন, সুতাং নদীর পানির দুগর্ন্ধে জন্য আমরা বাড়িঘরে থাকতে পারছিনা। এক সময় সুতাং নদীর মাছের জন্য দূর দুর্দান্ত থেকে মানুষ আসতো। এখন মাছ একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না।
মোঃ আলাই মিয়া (৮৫) বলেন, কোম্পানি আসার পর থেকেই নদীর পানির এই অবস্থা। সুতাং নদী আমাদের অনেক উপকার করত, মানুষ গোসল করতো, মাছ আহরণ করত। এখন আমরা খুব কষ্টের মধ্যে আছি। এই এলাকায় বিয়ে সাধি কেউ দিতে চাই না।
আব্দুর রহিমপুর পাল বাড়ির মৃতশিল্পী রণজিৎ পাল (৪৯) বলেন, আগে নদীর মাটি দিয়ে কাজ করতাম, কয়েক বছর ধরে তা করতে পারছি না। একই গ্রামের অনিমা রাণি পালন, ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করেও থাকতে পারি না দুর্গন্ধের জন্য।
উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ আমিরুল ইসলাম আলম বলেন, সুতাং নদীটি এলাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই নদীর পানি সেচের জন্য ব্যবহার করে অনেক কৃষক উপকৃত হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য বিগত কয়েক বছর ধরে শিল্পকারখানা হবার পর থেকেই নানান সমস্যা হচ্ছে। মানুষ পানি ব্যবহার করলে চর্মরোগ সহ নানান ধরণের অসুখ হয়। নদী এবং আমাদের বিলগুলোর মাছ বিনষ্ট হচ্ছে। পানিতে যত ধরণের প্রাণী আছে প্রায়ই দেখা যায় মরে ভেসে উঠে। ময়লা পানির কারণে যে পরিমাণ ফসল উৎপাদন হবার কথা তা হচ্ছে না। দূষণের কারণেই প্রাণী এবং মাছ ধ্বংস হচ্ছে। লাখাই উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি গ্রাম নদীর পাড়ে। এই গ্রামগুলোর মানুষ নদীর পানি ব্যবহার করতে পারছে না।
ড. জহিরুল হক শাকিল বলেন, হবিগঞ্জে সুশাসন না থাকাতে, পরিবেশগত মনিটরিং না থাকাতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততায় এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের অনাচারে এই এলাকার পরিবেশ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। হবিগঞ্জের ৫টি নদী সম্পূর্ণভাবে বিপন্ন হয়ে গেছে শুধুমাত্র হবিগঞ্জের শিল্পায়নের জন্য। এই শিল্পায়ন এবং প্রবৃদ্ধি কার জন্য? এখন যদি মানুষই না থাকেক তাহলে ভোগ করবে কে? নদীর পানি কালো আলকাতরার মতো প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা দেখেছি ব্যাঙ মরে ভেসে রয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, এই পানি যদি পশুপাখি খায় তাহলে প্রাণীগুলো মারা যাচ্ছে। এই পানি ব্যবহার করে দৈনন্দিন কাজকর্ম চলত, চাষাবাদ হচ্ছে না, প্রতিবছর এইখানে পূণ্য¯œান হত কিন্তু এখন তা হচ্ছে না। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ এলাকার জনপ্রতিনিধিদের দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তা না হলে কিছুদিন পর এখানে চরম মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে।
তোফাজ্জল সোহেল বলেন, নদী, খাল, বিল, জলাশয়ে শিল্পবর্জ্য নিক্ষেপের ফলে এই অঞ্চলের পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সকল ধরণের শিল্পবর্জ্য ‘উৎসে পরিশোধন’ বাধ্যতামুলক হলেও এই অঞ্চলে তা একেবারেই মানা হচ্ছে না। কলকারখানাগুলো শুরু থেকেই বেপরোয়াভাবে দূষণ চালিয়ে আসছে যা সংশ্লিষ্ট গ্রামসমূহের বাসিন্দাদের সাংবিধানিক অধিকারের উপর প্রত্যক্ষ আঘাত।
ইতিপূর্বে এ ধরণের কলকারখানার উৎসে বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এবং সুষ্ঠু শিল্পায়নে প্রয়োজনীয় ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারকে আহ্বান জানিয়েছি আমরা। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন বিগত অনেক বছর ধরে পাশর্^বর্তী গ্রামগুলোতে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটিয়ে আসছে। যত্রতত্র কৃষিজমি খাল ছড়া এবং নদীসহ সকল প্রকার জীবন ও জীবিকা শিল্প দূষণের শিকার হচ্ছে। কোনভাবেই কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান অপরিশেধিত বর্জ্য পরিশোধন নিশ্চিত না করে কারখানার বাইরের এলাকায় যে কোন ভাবে এবং কারখানার অভ্যন্তরে ভুর্গভস্থ পানি দূষণ করতে পারে না, এটি দেশের প্রচলিত আইন ও বিধি ব্যবস্থার পরিপন্থী। নদী-খাল-বিল জলাশয় রক্ষার দায়িত্বশীল যারা তাদের মাধ্যমেই ২০১৪ সালে শৈলজুড়া নামক খালটি কৃষি কাজের সেচ ব্যবস্থার জন্য পুনখননের মাধ্যমে কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া হয়। ফলে সহজেই ওই কোম্পানীগুলোর অপরিশেধিত বর্জ্য খালের মাধ্যমে সুতাং নদীতে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। যে কারণে নদী আজ মৎস্যশূন্য, নদীর পানি ব্যবহারকারীরা পড়েছেন মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। নদী হাও ও হওরে মাছ প্রজনন ক্ষমতা হারাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে দেশীল প্রজাতির মাছ।
তিনি বলেন, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন দেশের উন্নয়ন নয় বরং ধ্বংস যে ডেকে আনছে, তা সুতাং নদী এবং আশপাশের খাল বিলের চিত্র দেখলেই বুঝা যায। কলকারখানার দূষিত বর্জ্য এর হাত থেকে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা করে লাখো মানুষকে মানবিক বিপর্যয়ের থেকে রক্ষার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান তিনি।