জনগণের শ্রদ্ধা আর ভালবাসা নিয়ে নিজ গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত
শায়েস্তানগর থেকে পইল আটঘরিয়া সড়কটি সৈয়দ আহমদুল হকের নামে নামকরণের ঘোষণা দিলেন এমপি আবু জাহির
এসএম সুরুজ আলী ॥ দল-মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় সিক্ত হয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমদুল হক। শুক্রবার বেলা সাড়ে ৩টায় পইল নতুন বাজার মাঠে মরহুমের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার নামাজে জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণীর পেশার মানুষের ঢল নামে। জানাজার নামাজ শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মরহুমের দাফন সম্পন্ন হয়। জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করার জন্য জেলার বিভিন্ন স্থানের লোকজন সকাল থেকে মরহুমের পইল গ্রামের বাড়িতে ভিড় জমান। জানাজার নামাজের পূর্বে মরহুমের জীবনী নিয়ে বক্তব্য রাখেন এমপি অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহির, এমপি অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান, এমপি গাজী শাহনওয়াজ মিলাদ গাজী, হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা বিপিএম-পিপিএম (সেবা), প্রাক্তন বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম দস্তগীর, হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মিজানুর রহমান মিজান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আলমগীর চৌধুরী, বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডাঃ সাখাওয়াত হাসান জীবন, বিএনপি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক আলহাজ¦ জি কে গউছ, পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান শহীদ উদ্দিন চৌধুরী, হবিগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোতাচ্ছিরুল ইসলাম, বানিয়াচং উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম চৌধুরী, লাখাই উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুশফিউল আলম আজাদ, বাহুবল উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ খলিলুর রহমান, চুনারুঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির লস্কর, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল, মরহুমের ছোট ভাই পীর সৈয়দ সাজেদুর রহমান ও ছেলে ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ মইনুল হক আরিফ।
জানাজার নামাজ পরিচালনা করেন মরহুমের ছোট ভাই পীর সৈয়দ সাজেদুর রহমান। জানাজার নামাজের পূর্বে মরহুমের ছেলে ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ মইনুল হক আরিফ বলেন, আমার বাবা সৈয়দ আহমদুল হক চেয়ারম্যানের দায়িত্বকালে এ পর্যন্ত বিভিন্ন মামলা মোকাদ্দমা নিষ্পত্তি করার জন্য মানুষ প্রায় ৩০ কোটি টাকা জামানত হিসেবে রেখেছিলেন। মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে টাকাগুলো হস্তান্তর করেছেন। অবশিষ্ট যে টাকাগুলো রয়েছে সেই টাকাগুলো জামানতদার হিসেবে আমরা পরিশোধ করবো। তিনি বলেন, জীবদ্দশায় বাবা অনেক হত্যা মামলাও নিষ্পত্তি করেছেন। বাবা কারও কাছে কোন ধরণের ভুল করলে সেই ভুল ক্ষমা করে দেয়ার জন্য তিনি অনুরোধ জানান। তিনি সকলের কাছে তার বাবার জন্য দোয়া সকলের নিকট দোয়া কামনা করেন। মরহুমের ছোট ভাই পীর সৈয়দ সাজেদুল হক বলেন, আমার ভাই প্রায় ৩০ বছরের উপরে রাজনীতির সাথে জড়িত। তিনি জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পর পরিবারের চেয়ে জনগণকে বেশি সময় দিয়েছেন। এই দীর্ঘ পথ চলতে গিয়ে কোন প্রকার ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে তা ক্ষমা করার জন্য তিনি সকলের কাছে অনুরোধ করেন। তিনি মরহুম সৈয়দ আহমুদুল হকের জন্য সকলের কাছে দোয়া কামনা করেন।
হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমপি অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহির বলেন, অত্যন্ত জনপ্রিয় লোক ছিলেন মরহুম সৈয়দ আহমদুল হক। তিনি শালিস বৈঠকের মাধ্যমে হবিগঞ্জের অনেক সমস্যা সমাধান করেছেন। যা হবিগঞ্জের মানুষ আজীবন মনে রাখবে। তিনি আরো বলেন, একজন ভাল মানুষের কাজের মূল্যায়ন হিসেবে তার নামে হবিগঞ্জ শহরের শায়েস্তানগর থেকে পইল আটঘরিয়া সড়কটি সৈয়দ আহমদুল হকের নামকরণ করা হবে। এর সকল ব্যবস্থা আমি গ্রহণ করবো। তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। বক্তারা বলেন, মরহুম সৈয়দ আহমদুল হক ব্যক্তিগত জীবনে একজন নির্লোভ ও ভালো মানুষ ছিলেন। তার মৃত্যুতে হবিগঞ্জবাসীর যে ক্ষতি হয়েছে তা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। তাকে হারিয়ে হবিগঞ্জবাসী একজন অভিভাবককে হারালো। অন্যান্য বক্তারা তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জানান।
উল্লেখ্য, সৈয়দ আহমদুল হক ১৯৮৫ সালে প্রথমবার যখন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখন তিনি বিপুল ভোটে হবিগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর এই উপজেলা পরিষদে প্রতিটি নির্বাচনেই তিনি বিজয়ী হয়ে আসছিলেন। টানা চারবার তিনি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর মধ্যে একবার তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। শুধুমাত্র এবার উপজেলা নির্বাচনে তাঁকে পরাজিত করে হবিগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোতাচ্ছিরুল ইসলাম উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
সর্বমহলে ন্যায়ের প্রতিক হিসেবে পরিচিত সৈয়দ আহমদুল হক ১৯৪৯ সালের ৩১ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পইল গ্রামের সাহেব বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ জাহেদুল হক ওরফে ময়না মিয়াও পইল ইউনিয়নের বারবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। আহমদুল হক ১৯৬৮ সালে বৃন্দাবন সরকারি কলেজ থেকে বি.কম ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কয়েক বছর পইল উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে সমবায় অফিসে পরিদর্শক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। একপর্যায়ে জনগণের অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে পইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। দীর্ঘ সময় তিনি ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একজন সামাজিক বিচারক হিসেবে সৈয়দ আহমদুল হকের অত্যন্ত সুনাম রয়েছে।
‘পইলের সাব’ হিসেবে পরিচিত সৈয়দ আহমদুল হক বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টা ৩২ মিনিটে পইল গ্রামে নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ২ ছেলে, ১ মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর এক ছেলে সৈয়দ মইনুল হক আরিফ পইল ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অপর ছেলে সৈয়দ লুৎফুল হক এজাজ ইংল্যান্ড প্রবাসি। মেয়ে শ্রীমঙ্গলে স্বামীর সাথে বসবাস করছেন।