গ্যাসফিল্ডের পিছনের দিকের রাস্তাটি রাবার বাগানের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে গহীন বনে চলে গেছে ॥ দিনের বেলায়ই ওই রাস্তায় চলাচলে গা ছমছম করে
আতাউর রহমান কানন
১৪ নভেম্বর ২০০৭, বুধবার। আজ সকাল ১০টায় চুনারুঘাট উপজেলার উদ্দেশে বের হই। বের হওয়ার সময় ঢাকার বাসা থেকে আমাকে জানানো হয়েছে, আজ তাঁরা নতুন বাসায় ওঠতে যাচ্ছে। মালপত্র টানার জন্য লেবার নেওয়া হয়েছে। বর্তমান বাসা আর নতুন বাসা অতি সন্নিকটে।
আজ চুনারুঘাট ইউএনও অফিস-সহ কয়েকটি অফিস দর্শন-পরিদর্শনের রুটিন প্রোগ্রাম ছিল। অফিসসমূহ পরিদর্শন শেষে সদরদপ্তরে ফিরে দেড়টায় সার্কিট হাইজে অবস্থানরত বিচারপতি আবদুল মতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি মূলত জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি কার্যক্রম অবলোকনের নিমিত্তে আসেন। জেলা জজ সাহেব আমাকে তাঁর আগমনের বিষয়টি আগেই অবহিত করে লাঞ্চের দাওয়াত দেন। সাক্ষাৎ ও লাঞ্চ শেষে আমি অফিসে ফিরে আসি।
বিকেল তিনটায় মি. এডওয়ার্ডসহ কয়েকজন আমেরিকান আমার অফিসে আসেন। তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় জানলাম, তাঁরা হবিগঞ্জের বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ড সংলগ্ন ৪৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করতে চান। এ বিষয়ে তাঁদের স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা প্রয়োজন। আমি আলোচনা শেষে তাঁদের আশ্বস্ত করি যে, সরকারি পর্যায়ে সিদ্ধান্ত ও অনুমোদন হলে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হবে। মি. এডওয়ার্ড ‘থাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে খুশিখুশি ভাব নিয়ে দলবলে চলে যান।
১৫ নভেম্বর ২০০৭, বৃহস্পতিবার। সকালে থেকেই আজ আকাশটাটা মেঘলা। বঙ্গোপসাগরে ‘সিডর’ নামক ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। আমি সারাদিন মিটিং আর অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সকাল ১০টায় জেলার সার ডিলার, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের সাথে চলতি মৌসুমের সার ব্যবস্থাপনা নিয়ে মতবিনিময় সভা করি। এবার যাতে সারের কোনো ঘাটতি না থাকে তার জন্য আগাম প্রস্তুতিমূলক বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিই। অফিস শেষে বাসায় আসার পর সন্ধ্যায় ঢাকায় টেলিফোন করে জানতে পারি- বাসা শিফটের কাজ আজ সম্পূর্ণ শেষ। তবে গতকাল থেকেই বসবাস শুরু হয়েছে। আরও জনলাম- বিকেল থেকে ঢাকায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি অবশ্য হবিগঞ্জেও চলছে। টিভি চ্যানেল সংবাদে দেখি, রাত যত গভীর হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ ততটাই ভয়ংকর হয়ে ওঠছে। গভীর রাতে বাংলাদেশের উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চলের জেলাসমূহে আঘাত হানা শুরু করেছে। ভোর রাতে নাকি পুরোপুরি আঘাত হানা শেষ হবে। এমন দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় আমি কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি বুঝতেও পারিনি।
পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখি আকাশ মেঘেভরা। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। বিদ্যুৎ রাতেই চলে গেছে এখনও আসেনি। আমি জেলা নাজিরকে দিয়ে শহরের দোকান থেকে একটি ব্যাটারিওয়ালা রেডিও কিনে আনালাম। রেডিওর খবরে জানলাম, সিডর বাংলাদেশের উপকূলে মারাত্মক আঘাত হেনেছে। ব্যাপক জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সুন্দরবন তছনছ হয়েছে। সারাদেশ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে হবিগঞ্জের খবরাখবরও আসতে থাকে। হবিগঞ্জে তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও অনেক স্থানেই গাছপালা উপড়ে গেছে। আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় রুনা নামক পঞ্চম শ্রেণির একজন ছাত্রী তাদের বাড়ির গাছচাপায় মারা গেছে। সারাদিন পর রাত ৯টায় হবিগঞ্জে বিদ্যুৎ আসে। ঢাকার বাসায় খবর নিয়ে জানলাম, সারারাত ভীষণ ঝড় হয়েছে। নতুন বাসার দরোজা-জানালা সব খসে পড়ার নাকি অবস্থা হয়েছিল। আর সেই যে বিদ্যুৎ গেছে এখনও আসেনি।
রাতের হালনাগাদ সংবাদে দেখলাম, সুন্দরবনের গাছপালার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। প্রাণিকূলেরও ক্ষতি হয়েছে অভাবনীয়। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের ঘরবাড়ি-ফসল প্রায় নিশ্চিহ্ন। সরকারি-বেসরকারিভাবে নানাপ্রকার প্রচারপ্রচারণা ও সাবধানতা অবলম্বনের পরও নাকি প্রাথমিক হিসাবে ৫ হাজারের অধিক মানুষ ও আড়াই লাখ গৃহপালিত পশু-হাসমুরগি মারা গেছে। আর আনুমানিক ৮ লাখ মেট্রিক টন আমন ধান বিনষ্ট হয়েছে। এই ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার। বিশেষজ্ঞদের মতে সুন্দরবন নিজের বুক ঠেকিয়ে এই প্রলয়ংকরী ঝড় না থামালে ক্ষয়ক্ষতি আরও ব্যাপক হতো।
পরদিনও আকাশটা মেঘলা এবং শীতল আবহাওয়া। সকাল ১০টায় আমি বাসার অফিসে বসে ফাইলওয়ার্ক করছিলাম, এমন সময় বিপিএটিসির ‘কহড়ি ইধহমষধফবংয’ প্রোগ্রামের অধীন ফিল্ডট্রিপে আসা ৬ জন কর্মকর্তা আমার বাসায় সাক্ষাতে আসেন। তাঁদের সাথে জেলার বিভিন্ন বিষয় আলোচনা শেষে আমি মাধবপুর উপজেলায় যাই। সেখানে সাবেক সচিব এএইচএম আবুল কাশেম সাহেবের বাসায় দাওয়াত ছিল। স্যার আমার পূর্বপরিচিত। এমন সজ্জন নিরহংকারী কর্মকর্তার সচরাচর দেখা মিলে না। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আপ্যায়ন করেন। আমার প্রশাসনিক কাজকর্মের ওপর কিছু মূল্যাবান পরামর্শও দেন। আমি সেখান থেকে সাড়ে তিনটায় বাসায় ফিরে আসি।
২০ নভেম্বর ২০০৭, মঙ্গলবার। সকালে এসপি সাহেব টেলিফোনে জানান যে, গতরাতে হবিগঞ্জ গ্যাসফিল্ডের পাহাড়ি এলাকায় পুলিশের টহলপার্টিকে দুষ্কৃতকারীরা আক্রমন করে কয়েকটি অস্ত্র লুট করে নিয়ে গেছে। ডিআইজি সাহেব সিলেট থেকে ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। আমি থাকলে ভালো হয়। আমি এসপি সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে সাড়ে ১০টায় ঘটনাস্থলে যাই। এর কিছুক্ষণ পরেই ডিআইজি সাহেব আসেন। গ্যাসফিল্ডের পিছনের দিকের রাস্তাটি রাবার বাগানের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে গহীন বনে চলে গেছে। দিনের বেলায় যে রাস্তায় চলাচলে গা ছমছম করে, সেখানে কী কারণে টহল পার্টি গভীর রাতে গেল বোধগম্য না। ডিআইজি সাহেবও পুলিশ টহলপার্টির এমন কর্মকান্ডে বিস্ময় প্রকাশ করেন। সকাল থেকেই শতাধিক পুলিশ অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘটনাস্থলের আশেপাশের বনে চিরুনি অভিযান শুরু করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি। অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত এ অভিযান অব্যাহত রাখার জন্য নির্দেশ দিয়ে ডিআইজি সাহেব চলে যান। অতঃপর আমিও ঘটনাস্থল থেকে ২টায় নিজ অফিসে ফিরে আসি।
২১ নভেম্বর ২০০৭, বুধবার। সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে কাজেকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এরমধ্যে ১২টার দিকে টেনিস ক্লাবের সেক্রেটারি বাছিত চৌধুরী মাঠ পুনর্নির্মাণ কমিটির সক্রিয় সদস্য মো. মোতাব্বির হোসেনকে নিয়ে আমার অফিসে এসে মাঠের কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য অনুরোধ জানান। আমি এ সময় নিমরাজি থাকলেও তাঁদের সাথে বের হয়ে যাই। গিয়ে দেখি মাঠ নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ফিনিশিং ও রঙের কাজ বাকি। মাঠ নির্মাণ কমিটির সদস্যদের একনিষ্ঠ কর্মের জন্য ধন্যবাদ দিই।
আজ সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষ্যে হবিগঞ্জের সেনা ইউনিটের সিও আমাকে ও এসপিকে লাঞ্চের দাওয়াত দিয়েছেন। আমি টেনিস মাঠ থেকেই সেখানে যাই। এ দিবসটি সেনাবাহিনী নানা কর্মসূচির মাধ্যমে উৎসবমুখর পরিবেশে পালন করে থাকে। লাঞ্চ শেষে সেখান থেকে ফিরে হবিগঞ্জ পৌর পাঠাগারের বিশেষ সাধারণ সভায় যোগদান করি। প্রাণহীন পাঠাগারটি জীবন ফিরে পাচ্ছে দেখে বেশ ভালো লাগল। গত সভার পর পাঠাগারের অঙ্গসৌষ্ঠবেও অনেক পরিবর্তন লক্ষণীয়। নতুন সংযোজিত সিএফএল টিউবলাইটের উজ্জ্বল আলোতে আগের টিমটিমেভাব দূর হয়েছে। নতুন কিছু আসবাবও প্রবেশ করেছে। এখন শুধু পাঠক বাড়লেই পাঠাগারটি হেসে ওঠবে। আজও বিস্তর আলোচনা করে কিছু প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২৩ নভেম্বর ২০০৭, শুক্রবার। সকাল থেকে বাসার পানির পাম্প দিয়ে পানি ওঠছে না। গণপূর্ত বিভাগে জানানো হয়েছে। জেলা নাজির ও গণপূর্তের মেকানিকগণ ছোটাছুটি-দৌড়াদৌড়ি করেও চালু করতে পারেন না। নির্বাহী প্রকৌশলী পর্যন্ত ছুটে এসেছেন। সবাই গলদগর্ম। টানা তিন ঘণ্টা ব্যর্থ চেষ্টা করে বাজার থেকে একটি নতুন পাম্প এনে লাগিয়ে সমস্যা সমাধা করা হয়। সরকারি মেকানিক্স নষ্ট পাম্প সারানোর কাজ যে ভুলে গেছেন, তা ভেবে আমার খারাপই লাগল।
সকাল ১১টায় ঢাকা থেকে আমার ব্যাচমেট জামাল হোসেন মজুমদার ও শামসুল আলম ভূঁইয়া আসেন। তাঁরা দুজনই যথাক্রমে সিলেট ও কিশোরগঞ্জের ডিসি ছিলেন। মাত্র কয়েক মাস জেলায় ‘ওজারতি’র পরই প্রত্যাহার হয়েছেন। তাঁরা ঘণ্টাখানেক আমার সাথে কাটিয়ে চলে যান।
পরদিন সকাল ১১টায় জেলা পরিষদ মিলনায়তনে হবিগঞ্জ হিন্দু ধর্মীয় নেতাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি। ‘মানব সম্পদ উন্নয়নে ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। এতে ঢাকা থেকে প্রকল্প পরিচালক ও হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব গৌতম কুমার আইচ-সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ যোগদান করেন।
২৬ নভেম্বর ২০০৭, সোমবার। সকালে নবীগঞ্জ উপজেলায় যাই। পথিমধ্যে একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি হাইস্কুল ও একটি কেজি স্কুল অকস্মাৎ পরিদর্শন করি। ছাত্র-শিক্ষকের উপস্থিতি পর্যালোচনা এবং ক্লাসে ক্লাসে ঢুকে পড়ার মান যাচাই করি। এসব গ্রামীণ স্কুলের কাজ যা হওয়ার তা-ই। মান বাড়াতে হলে প্রশিক্ষিত মেধাবী শিক্ষকের যে কোনো বিকল্প নেই, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
১১টায় নবীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে পৌঁছে পূর্বনির্ধারিত শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার বোর্ডে সভাপতিত্ব করি। সন্ধ্যা ৭টায় সদর দপ্তরে ফিরে আসি।
৩০ নভেম্বর ২০০৭, শুক্রবার। আজ বাইরে কোনো কাজ না থাকায় সারাদিন বাসাতেই নিজের মতো করে সময় কাটাই। রাত ৭টায় হবিগঞ্জ সাহিত্য পরিষদের আয়োজিত সাহিত্যসভায় যোগদান করি। এ সভায় দিন দিন কবি-সাহিত্যিকের সংখ্যা যে বেড়েই চলছে তা বিগত সভাগুলোতে অংশ নিয়েই বুঝেছি। অনেকেই বলে থাকেন, আমি হবিগঞ্জে আসার পর নাকি এ জগতে শুক্লপক্ষের জোয়ার বইছে। যা হোক, সাহিত্য আসরে কবিদের ভিড়ে গল্প লেখকগণ তাদের গল্পপাঠের তেমন একটা সময় পান। তবে দু-এজনকে গল্পের অংশবিশেষ পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। আসলে সাহিত্যাসরে কবিতা-ছড়া পাঠের বাইরে অন্য লেখা পাঠের কোনো সময়-সুযোগ কিংবা শ্রোতা-আকর্ষণ থাকে না। সাহিত্যসভা রাত সাড়ে ৮টায় সমাপ্ত হয়।
(চলবে…)