আমি সংকল্প করলাম, যখন সময় পাব হবিগঞ্জের ওপর একটা বই লিখব
আতাউর রহমান কানন
১০ নভেম্বর ২০০৭, শনিবার। আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কিন্তু এখন ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ণ কার্যক্রম অগ্রাধিকার। তাই এ কাজের জন্য ছুটিছাটা বা দিনরাত বলে কিছু নেই। আজ প্রকল্পের বাস্তবায়ন উপলক্ষ্যে জনসচেতনতা ও গুরুত্ব বোঝানোর জন্য র‌্যালির আয়োজন করা হয়েছে। সকাল ১০টায় কর্নেল, এসপি ও আমি জেলার অন্যান্য অফিসার এবং সর্বস্তরের জনগণ সমভিব্যাহারে ব্যানার-ফেস্টুন-মাইকসহ এক বর্ণাঢ্য র‌্যালি নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করি। সাড়ে ১১টায় র‌্যালি শেষ হয়।
র‌্যালি থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বাসভবনের অফিসে বসেছে মাত্র, এমন সময় আমার সিএ আশরাফ বললেন, স্যার, আবদুল আউয়াল তালুকদার নামে একজন আপনার সাথে দেখা করতে চান, পাঠাব স্যার?
-কোথা থেকে এসেছেন?
-হবিগঞ্জেরই, ঢাকায় থাকেন।
-আচ্ছা পাঠান।
আমার অফিসকক্ষে সালাম দিয়ে ঢুকল যে দর্শনার্থী, তিনি একজন টগবগে সুদর্শন তরুন। আমি তাঁকে আগে দু-একবার দেখেছি, টুকটাক কথাও হয়েছে মনে পড়ল। তাঁকে ‘বসেন’ বলাতে তিনি আমার সামনের চেয়ারে চটপটে বসে পড়লেন এবং নিজে থেকেই বললেন, স্যার, আমার নাম আউয়াল তালুকদার। আমি ঢাকায় থাকি। ‘বার অ্যাট ল’ করছি। হবিগঞ্জের নজরুল একাডেমির বর্তমান সেক্রেটারি, আর সাহিত্য পরিষদের সাথেও যুক্ত আছি। আপনি আমাদের সংগঠনের বেশ কটি অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। আপনার সঙ্গে কথা হয়েছে। আপনি জেলা প্রশাসকের বাইরেও যে একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সে পরিচয় পেয়েছি। কিছুদিন আগে পৌর মিলনায়তনে আপনার লেখা গান নিয়ে যে অনুষ্ঠান হয়েছে, সেখানে আমি ছিলাম। আপনার লেখা একটা বইও আমি পড়েছি। আপনার সাথে সময় নিয়ে সরাসরি কথা বলার ইচ্ছে থেকেই আজ এসেছি।
আমি মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনছিলাম। বেশ ঝরঝরে কথাগুলো আমার মন কাড়ে। আমি তাঁকে বললাম, তা বেশ। আপনার বাড়ি হবিগঞ্জের কোথায়?
-শায়েস্তাগঞ্জ, কলেজের ঠিক পাশেই। শহরের পুরানো মুন্সেফ কোয়ার্টারেও আমাদের বাসা আছে।
-কিছু করেন?
-না স্যার, এখনও পড়ালেখাতেই আছি।
-বাড়িতে আসা-যাওয়া আছে?
-বন্ধের মধ্যে বাড়িতে চলে আসি। স্যার, আমার আব্বাকে আপনি চিনবেন।
-কী নাম উনার?
-নিম্বর আলী তালুকদার। বঙ্গবন্ধুর সময়ের নেতা ছিলেন।
-তাই নাকি! উনার এখন কী অবস্থা?
-আব্বা তো এখন আর নাই। ১৯৯৫ সালে মারা গেছেন।
-আঃ! বড় ভালো মানুষ ছিলেন। আমি আপনাদের এখানে যখন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম, সেসময় দু-তিনবার তিনি আমার কাছে এসেছেন। অতীতের অনেক কথাই বলতেন। শীত-গ্রীষ্মে তাঁর গায়ে মুজিবকোট দেখেছি। এমন মুজিবভক্তের কালেক্রমে দেখা মিলে।
-স্যার, আমার একটা অনুরোধ আছে আপনার কাছে!
-বলেন, শুনি!
-আপনি লেখক মানুষ। হবিগঞ্জ নিয়ে একটা বই লিখবেন।
আমি হেসে বললাম, সব সময় সবকিছু নিয়ে তো লেখা যায় না। তবে এখন ডায়েরি লিখে যাচ্ছি। পরে হয়তো সময়-সুযোগে তা বইয়ে রূপ দেওয়া যাবে।
-স্যার, আমার কোনো সহায়তা লাগলে বলবেন।
-কী ধরনের সহায়তা করতে পারবেন?
-আপনার লেখার জন্য তথ্য জোগাড় করে দিতে পারব।
-আচ্ছা! লাগলে আপনাকে জানাব।
আউয়াল তালুকদার সালাম দিয়ে চলে যান। আমি এই সংস্কৃতিমনা তরুণকে নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম। তাঁর মানসিক উচ্ছলতা ও স্পৃহা আমার মনকে দোলায়িত করল। আমি সংকল্প করলাম, যখন সময় পাব এই হবিগঞ্জের ওপর একটা বই লিখব।
পাঠক, এদিনের পর হবিগঞ্জে থাকা অবস্থায় আউয়াল তালুকদারের সাথে দু-একটি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেখা ছাড়া আমার আর তেমন করে সাক্ষাৎ ঘটেনি। তবে হবিগঞ্জ থেকে ঢাকায় চলে আসার পর সচিবালয়ে তিনি দু-তিনবার আমার সাথে দেখা করেছেন। মাঝে মাঝে টেলিফোন করে কথা বলতেন। বাংলা একাডেমির একুশে গ্রন্থমেলাতেও দু-তিনবার দেখা হয়েছে। তিনি খোঁজ নিতেন- আমার কোনো বই বের হয়েছে কি না, হবিগঞ্জের ওপর লিখেছি কি না। বছর বছর আমার বই ঠিকই বের হয়েছে, তবে হবিগঞ্জ নিয়ে নয়। এভাবে পনের বছর অতিবাহিত হয়েছে। নানা দিক দিয়ে হবিগঞ্জের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। খোয়াই নদীর জল অনেক গড়িয়েছে। আমার সেই সময়ের লিখিত ডায়েরি বই আকারে অবশেষে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। শুনেছি, আউয়াল তালুকদার ব্যারিস্টার হয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। এবার তিনি বইটি পেলে নিশ্চয়ই খুশি হবেন!
১১ নভেম্বর ২০০৭, রবিবার। সকাল ৯টায় হবিগঞ্জ পৌরসভায় সর্বপ্রথম আমার ছবি তোলার মাধ্যমে ভোটার রেজিস্ট্রেশন ও ছবি তোলার কার্যক্রম শুরু হয়। এই কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিভাগীয় কমিশনার আজিজ হাসান। তিনি ১১টায় চলে যান। এরপর আমি হবিগঞ্জ পৌর এলাকার কয়েকটি রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্র পরিদর্শন করে নিজ অফিসে ফিরে আসি। কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করে আমার প্রতীতি জন্মে যে, যেভাবে সেনাবাহিনীর তৎপরতা ও জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততায় মানুষ ছবি তোলার জন্য কেন্দ্রে আসছে, তাতে এবারের প্রকল্প সফল না হয়ে পারে না।
পরের দিন সোমবার সারাদিন অফিসের কাজেই ব্যস্ত ছিলাম। সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত নির্মাণাধীন ডায়াবেটিক ও জেনারেল হাসপাতালের চেক গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগদান করি। পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের অন্যতম পরিচালক হবিগঞ্জেরই সন্তান মো. ইয়াকুবের পক্ষ থেকে প্রদত্ত ১০ লাখ টাকার অনুদানের চেক গ্রহণ করা হয়। (চলবে…)