শায়েস্তাগঞ্জ রেলজংশনের পার্কিংলটে অবৈধ দখলকারীদের অনেকগুলো পাকাভবন ও মার্কেট গুঁড়িয়ে দিই

আতাউর রহমান কানন

৩ এপ্রিল ২০০৭, মঙ্গলবার। আজ সকাল ১০টায় সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনির, এসপি মান্নান ও আমি একজোট হয়ে শায়েস্তাগঞ্জ রেলজংশনে যাই। সেখানের টার্মিনালের পার্কিংলট পরিষ্কার করার জন্য সকালেই বুলডোজার-এস্কেভেটরসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি এবং লেবার প্রেরণ করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটসহ পর্যাপ্ত পুলিশ ও সেনা সদস্য মোতায়েন করা হয়। একটা যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি করে অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করি। পার্কিংলটে অনেকগুলো পাকাভবন ও মার্কেট গুঁড়িয়ে দিই। উচ্ছেদ চলাকালীন কাউকেই ধারেকাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয় না। এ এলাকার মার্কেট সমিতির সভাপতি-সেক্রেটারি পৌরসভার মেয়রকে নিয়ে একবার আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে দূর থেকে অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকেন। উচ্ছেদ কার্যক্রমের শেষ পর্যায়ে রেলস্টেশনের ম্যানেজারের কামরায় বসে তাঁদেরকে ডেকে আনি। তাঁরা অনেক যুক্তি ও কাগজপত্র দেখাতে থাকেন। আরএস খতিয়ানের মালিকানার কাগজপত্রও প্রদর্শন করেন। আমি আগেই রেলওয়ের কাগজপত্র দেখেছিলাম। সিএস খতিয়ান ও অধিগ্রহণের গেজেটভুক্ত মালিক রেলওয়ে কিন্তু কীভাবে কীসের বলে অবৈধ দখলকারীগণ আরএস খতিয়ানের মালিক বনে গেলেন, তার কোনো পূর্বসূত্র দেখাতে পারলেন না। তখন কর্নেল সাহেব তাঁদের বললেন, ‘এসব কাগজপত্র নিয়ে দ্রুত চলে যান। অযথা ঝামেলা পাকাবেন না।’ এ গরম কথায় তাঁরা ওইসব কাগজপত্র গুটিয়ে চলে গেলেন।
অপরদিকে হবিগঞ্জ শহরের রাস্তা প্রশস্তকরণের জটিল কাজটি সেনাবাহিনীর টহল ও তত্ত্বাবধানে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে শুনেছি; কিন্তু আমার আর সরেজমিন দেখা হয়নি। আমরা শায়েস্তাগঞ্জের কাজ শেষ করে সে রাস্তার সর্বশেষ অবস্থা পরিদর্শনে যাই। তখন আর চৌধুরীবাজার এলাকায় যানজট ছিল না বললেই চলে। ভাঙাপড়া দোকানঘরের মালিকদের মনে কষ্ট থাকলেও ওই পথে যাতায়াতকারীগণ বেজায় খুশি। তাঁদের আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে না।
আজ সন্ধ্যায় সরকারি কৌঁসুলি (জিপি) আমাকে টেলিফোনে জানান যে, শায়েস্তাগঞ্জের উচ্ছেদের ঘটনায় আমাকে বিবাদী করে নাকি এ পর্যন্ত ১৮টি দেওয়ানি মামলা দায়ের হয়েছে। বর্তমান সরকারের ব্যাকরাউন্ড পাওয়ারপ্লের অন্যতম প্লেয়ারের এক ভাইয়ের ইন্দনে নাকি এই মামলাসমূহ দায়ের হয়েছে। আমার আর বোঝার তেমন কিছু বাকি রইল না। তখন ভাবলাম- ষাড়ের নতুন শিং গজালে নাকি শোলায় এবং সে জন্য যেখানে সেখানে গুঁতো মারে। তাই শিং বেড়ে ওঠার আগেই ভেঙে দেওয়া দরকার।
জিপির সাথে কথা শেষে আমি বিষয়টি কর্নেলকে জানালে তিনি বললেন, ‘ডোন্ট ওয়ারি, আমি আজ রাতেই সব কটাকে ক্যাম্পে আনব।’
এসব দেওয়ানি মামলায় জেলা প্রশাসকদের ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এমন মামলা তাঁদের বিরুদ্ধে সচরাচর হয়েই থাকে। আর এ সব মামলা কনটেস্ট করতে জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণে সরকারি উকিলও রয়েছেন। তবু প্রাথমিকভাবে খারাপ লাগল এই ভেবে যে, মানুষের কাছে ন্যায়-অন্যায়ের বিবেচনার চেয়ে নিজ স্বার্থই বেশি বিবেচ্য।
রাত কেটে যায়। পরদিন সকালে কর্নেল সাহেব জানান যে, শায়েস্তাগঞ্জ ঘটনার পালের গোদাসহ কয়েকজনকে ধরে আনা হয়েছে। আজই তাঁরা সব মামলা প্রত্যাহার করে নিবেন বলে জানিয়েছেন।
৫ এপ্রিল ২০০৭, বৃহস্পতিবার। সকালে অফিস হয়ে সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কামড়াপুর বাইপাস সড়কের কাজ পরিদর্শনে যাই। কাজের অগ্রগতি ও মান সন্তোষজনক বলে প্রতীয়মান হয়। সেখান থেকে ১১টায় সুবিদপুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে সেখানে নির্মিতব্য ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনের কাজ উদ্বোধন করি। সুবিদপুর থেকে সরাসরি হবিগঞ্জ গ্যাসফিল্ডে যাই। সেখানে সাভারস্থ বিপিএটিসির রেক্টর আবু মো. মনিরুজ্জামান ৩০ জন যুগ্মসচিবের একটি টিম নিয়ে ফিল্ডট্রিপে আসেন। গ্যাসফিল্ডের কার্যক্রম দেখেন। আমি তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে থাকি । বিকেল ৩টায় তাঁরা সিলেট চলে গেলে আমি আমার অফিসে ফিরে আসি।
সন্ধ্যা ৭টায় ওহংঃধষষধঃরড়হ ঈবৎবসড়হু ড়ভ জড়ঃধৎু ঈষঁন ড়ভ ঐধনরমধহল এ প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি। অভিজাত স্বেচ্ছাসেবী এ ক্লাবের জমকালো অনুষ্ঠানে এসে নিজেকেও অভিজাত মনে হলো। ইংরেজি ভাষায় পরিচালিত এ অনুষ্ঠানের বক্তাগণও তাঁদের বক্তব্য ইংরেজিতে রাখেন। তবে এতে একটি বিশেষ সুবিধা লক্ষ্য করলাম যে, বক্তা ও বক্তব্য ভাষার কারণেই সীমিত থাকল। রিচ ডিনারের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শেষ হয়।
৬ এপ্রিল ২০০৭, শুক্রবার। বাইরে কোনো কাজ না থাকায় সারাদিন বাসাতেই কাটাই। কয়েকদিন পর আজ রাতে আবার টেনিস ক্লাবের মাঠে যাই। খেলার এক পর্যায়ে ডান পায়ের হাঁটুর নিচে হঠাৎ মাসল্ পুল হয়। আমি বসে পড়ি। পা অনেকক্ষণ নাড়াতে পারি না। একজন ম্যাসাজ করে দেন। আমি সে অবস্থায় প্রায় অচল পা নিয়ে বাসায় আসি। ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ ও হটওয়াটার সেঁক নিই। সারারাত যন্ত্রণায় প্রায় নির্ঘুমে কাটালাম।
পরের দিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় বাসায় একরকম রেস্টেই কাটালাম। পায়ের ব্যথার সামান্য উন্নতি হয়েছে। বিকেল থেকে পা টেনে টেনে হাঁটতে পারছি।
৮ এপ্রিল ২০০৭, রবিবার। সকাল ৯টায় অফিসে যাই। সকাল থেকে বিকেল ২টা পর্যন্ত একটানা ৯টি মাসিক সভা করি। এরপর বিকেল আড়াইটায় হবিগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের দায়িত্বরত সেনা কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুজিবর রহমান আমার অফিসে আসেন। তিনি পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বিশেষ আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সভা করেন এবং কিছু পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেন। তিনি চলে গেলে আমি অফিসের কাজ করে বিকেল সোয়া ৫টায় বাসায় ফিরে আসি। সারাদিন কাজের ব্যস্ততায় পায়ের ব্যথার কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম। বাসার সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠার সময় সেটা আবার টনটনিয়ে জানান দিলো।
৯ এপ্রিল ২০০৭, সোমবার। আজ অফিস থেকে বেরিয়ে পূর্ব নির্ধারিত প্রোগ্রাম অনুযায়ী শায়েস্তাগঞ্জ থানা পরিদর্শনে যাই। আমি বড়লেখায় ইউএনও থাকাকালে সেখানকার থানার ওসি ছিলেন সিকান্দর আলী। এছাড়া তিনি ও আমি ঢাকার একই মহল্লার স্থায়ী বাসিন্দা। অমায়িক আচরণের এই মানুষটি আজ আমাকে জানালেন যে, তিনি চাকরি ছেড়ে দিবেন। আমি কারণ জানতে চাইলে বললেন যে, এখন আর চাকরি করার পরিবেশ নেই, এছাড়া চাকরির বয়সও প্রায় শেষের দিকে। এখন মানসম্মান নিয়ে ফিরে যেতে পারলেই শান্তি। আমি বয়স্ক এই পুলিশ অফিসারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। এরপর থানার রুটিন পরিদর্শন সেরে অদূরে অবস্থিত শায়েস্তাগঞ্জ ইউনিয়ন ভূমি অফিস যাই। এ ভূমি অফিস পরিদর্শন শেষে বিকেল তিনটায় নিজ অফিসে ফিরে আসি। (চলবে…)