বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষ বংশ পরিচয় ও বাড়ির নামের বিষয়ে বেশ সজাগ
বংশ নামের মতো বাড়ির নামও এরা ব্যবহার করেন। অধিকাংশ বাড়িতে ঐতিহ্যবাহী নামখচিত সুদৃশ্য তোরণ রয়েছে। আবার বাড়ি থেকে দূরে অ্যাপ্রোচ রোডের মাথায়ও বড়বড় ফটক তৈরি করে ‘সৈয়দ বাড়ি’, ‘চৌধুরী বাড়ি’, ‘তালুকদার বাড়ি’, ‘বড়বাড়ি’…ইত্যাদি নামাঙ্কন করা হয়
আতাউর রহমান কানন
আমার কোর্টের পরবর্তী ধার্য তারিখের আগেই মিস্ মামলা দায়েরকারী চৌধুরীপক্ষ মামলাটি বিজ্ঞ জজ কোর্টে তলব করিয়ে নেন। এতে আমি একরকম রেহাই পাই। মাস দুই পরে নথিটি আমার কোর্টে ফেরত এলে দেখা যায় বিজ্ঞ জেলা জজ মিস্ আপিল মামলাটির আবেদন শুনানি নিয়ে খারিজ করে দিয়েছেন। এরপর আমার কোর্ট থেকে মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য পক্ষদ্বয়কে নোটিশ দিলে অচৌধুরীপক্ষ হাজির হয়ে জবাব দাখিল করলেও মামলা দায়েরকারী চৌধুরীপক্ষ পরপর কয়েকটি ধার্য তারিখ বিনা তদবিরে অনুপস্থিত থাকেন। মামলার বিষয়ে চৌধুরীপক্ষ ইন্টারেস্ট হারিয়েছেন মর্মে ঘোষণা দিয়ে আমি মিস্ মামলাটির ওপর ইতোপূর্বে প্রদত্ত শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অন্তর্বতী আদেশ চুড়ান্ত করত মামলাটি নথিজাত করি।
দ্বিতীয় মিস্ মামলাটির ওপরও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অন্তর্বতী আদেশ দিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে ডিসি অফিসের একজন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে তদন্ত করানো হয়। তদন্ত প্রতিবেদনানুযায়ী, সংশ্লিষ্ট মাদরাসার সভাপতি নবীগঞ্জের ইউএনও’র নির্দেশ মতে আলমারিটি দাতাকে ফেরত দেওয়ায় বিরোধটির জলন্ত আগুনে পানি পড়ে। অভিযোগকারীপক্ষ মামলার আর তদবির না করায় মামলাটি নথিজাত হয়ে যায়।
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, বংশ পরিচয় ও বাড়ির নামের বিষয়ে এরা বেশ সজাগ। বংশ নামের মতো বাড়ির নামও এরা ব্যবহার করেন। অধিকাংশ বাড়িতে ঐতিহ্যবাহী নামখচিত সুদৃশ্য তোরণ রয়েছে। আবার বাড়ি থেকে দূরে অ্যাপ্রোচ রোডের মাথায়ও বড়বড় ফটক তৈরি করে ‘সৈয়দ বাড়ি’, ‘চৌধুরী বাড়ি’, ‘তালুকদার বাড়ি’, ‘বড়বাড়ি’…ইত্যাদি নামাঙ্কন করা হয়।
২৭ অক্টোবর ২০০৬, শুক্রবার। সারাদিন বাসাতেই কাটাই। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ আজ শেষ হচ্ছে। বিগত কয়েকদিন ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়ে একটা ধোঁয়াশা চলছে। বিএনপি নিয়মানুযায়ী যাকে নির্বাচন করে রেখেছেন তিনি সর্বশেষ অবসরে যাওয়া বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কে.এম. হাসান। এই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের শুরু থেকেই আপত্তি রয়েছে। বিএনপি ঘরানার এই বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করার জন্য চারদলীয় জোট সরকার কৌশলে বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার বয়স বাড়িয়ে ৬৭ করেছে। এই কৌশলকে অপকৌশল আখ্যায়িত করে বিচারপতি কে.এম. হাসানকে কোনোক্রমেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪দলীয় জোট মেনে নিবে না বলে বিগত কয়েক মাস ধরে সংগ্রাম-আন্দোলন করে আসছে। এই সংগ্রাম-আন্দোলনের চাপে পড়ে নানাজনের নামও আসে। শেষমেশ কে.এম. হাসান প্রধান উপদেষ্টা হতে অস্বীকৃতি জানানোয় প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়টি ঝুলে যায়। শোনা যাচ্ছে মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টারও অতিরিক্ত দায়িত্বপালন করবেন। তবে ১৪দলীয় জোট সারাদেশে অবরোধ-আন্দোলন অব্যাহত রাখে।
২৮ অক্টোবর ২০০৬, শনিবার। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বড়ই টালমাটাল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪দলীয় জোট ঢাকাসহ সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে রেখেছে। সকাল থেকেই ঢাকায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউ-পল্টন এলাকায় লাঠি-বৈঠাসহকারে সমাবেশ অব্যাহত রাখে; অপরদিকে বিএনপি চারদলীয় জোট বায়তুল মোকাররম এলাকায় দা-কুড়াল নিয়ে যেকোনো তান্ডব মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকে। হবিগঞ্জেও আন্দোলন তুঙ্গে। সারাদিন একটা উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটাতে হয়। পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট সজাগ থাকে। দিন গড়িয়ে রাত নামে। টিভি চ্যানেলগুলোও সারাদিন গরম গরম নিউজ আপডেট দিতে ব্যস্ত থাকে। শেষমেশ রাত ১০টায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিজেই শপথ গ্রহণের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাতের শেষ সংবাদে জানা যায়, লাঠি-বৈঠার অবরোধ-আন্দোলনে ও সংঘাতে দেশে এ যাবৎ মোট ২৪ জন মারা গিয়েছে। বহু আহত হয়েছে। এই অবরোধ আগামীকাল পর্যন্ত চলবে বলে বিরোধী দল থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়। রাতে হবিগঞ্জেও বিক্ষোভ-ভাঙচুর হয়। দেশের এমন পরিস্থিতি আমাদের প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলে। জনগণের জানমাল রক্ষা করাই এখন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
পরের দিন ঈদের ছুটি শেষে অফিস খুলে। আমি সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে বসি। আমাদের ছুটিতে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ অফিসে ফিরেছেন। তাঁদের সাথে সভাকক্ষে এক জরুরি সভা করি। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় করি। এরপর বেলা সাড়ে ১২টায় এসপিকে সঙ্গে নিয়ে আমার অফিসের সভাকক্ষে সর্বদলীয় সভা ডাকি। গতকাল রাতে হবিগঞ্জ শহরের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের বাসায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ভাঙচুরের ঘটনায় সাবেক এমপি আবু লেইছ মুবিন চৌধুরী ও সাবেক পৌর মেয়র শহীদ চৌধুরীর বাসায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। শহরের বিশিষ্ট এই দুই রাজনীতিবিদ সভায় যোগদান করে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে গভীর রাতে তাঁদের বাসা আক্রমণের ভয়াবহ বর্ণনা দেন। সভায় পক্ষ-বিপক্ষের অনেক বক্তাই বক্তব্য রাখেন। তবে হবিগঞ্জে ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে সবাই একমত হন। সভা শেষে সভায় যোগদানকারী সকলেই শহরে একটা শান্তি মিছিল বের করি।
৩০ অক্টোবর ২০০৬, সোমবার। সারাদেশ কেমন যেন একটা অস্থিরতার ভেতর হাবুডুবু খাচ্ছে। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়ায় এ অস্থিরতার স্বাভাবিক সমাধানের কোনো শুভলক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আমি সকালে অফিসে গিয়ে আমার অফিসারদের নিয়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করি। তবে আজ বিরোধীদলের অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার হওয়ায় জনজীবনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে।
৩১ অক্টোবর ২০০৬, মঙ্গলবার। ঈদের বন্ধ কাটাতে ঢাকা থেকে আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এসেছিল। কিন্তু দেশের এমন নাজুক অবস্থায় তাদের নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার কোনো মানসিকতা ছিল না। আজ তারা নিজেরাই জেলা নাজির আবদুস সামাদের সহায়তায় বাহুবল উপজেলায় বেড়াতে যায়। ইউএনও বাহুবল তাদের নিয়ে একাত্তরের বধ্যভূমি, রশিদপুর গ্যাস ফিল্ড, রশিদপুর চা বাগান ও রূপাইছড়া রাবার বাগান দেখায়। আমি অফিসে নানামুখী কাজে ব্যস্ত ছিলাম। ওরা বেড়ানো শেষে সন্ধে ৬টায় বাসায় ফিরে আসে।
আজ রাতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ১০জন উপদেষ্টা নিয়োগ পেয়ে শপথ গ্রহণ করেন। এরা হলেন:- ১. বিচারপতি ফজলুল হক ২. ড. আলি আকবর খান, ৩. সিএম সফি সামি, ৪. লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী (অব.), ৫. এম. আজিজুল হক, ৬. জনাব ধীরাজ কুমার নাথ, ৭. প্রফেসর সুফিয়া রহমান, ৮. বেগম ইয়াসমিন মোরশেদ, ৯. জনাব মাহবুবুল হক ও ১০. অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল।
উপদেষ্টাদের শপথ নেওয়ার পর ১৪-দলীয় জোটের পক্ষ থেকে এক প্রতিক্রিয়ায় জানানো হয়, তাঁরা নবনিযুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবেন।
(চলবে…)