একটি উপজেলায় এত দেশীয় মারণাস্ত্র থাকতে পারে তা অবিশ্বাস্য বটে!
হবিগঞ্জ তথা হাওড় এলাকার ঘরে ঘরেই এইসব দেশীয় অস্ত্র সংরক্ষণ করা হয়। আর তুচ্ছ বিষয় বা ছুতানাতার অজুহাতে সংঘর্ষে লিপ্ত জনগণ এই অস্ত্র অহরহ ব্যবহার করে থাকে। এসব অস্ত্রে প্রতিবছরই অনেক হতাহত হয়
আতাউর রহমান কানন
৭ সেপ্টেম্বর ২০০৭, শুক্রবার। আজ সকাল থেকেই আকাশে ভারি মেঘেরা মুখভার করে আছে। যেকোনো সময়ই কান্নায় ভেঙে পড়তে পারে। আমার আজ মাধবপুর পৌরসভার গরুর হাট উদ্বোধনের প্রোগ্রাম রয়েছে। আকাশের এমন বেদনা-বিধুর অবস্থার মধ্যেই সকাল ১১টায় মাধবপুরের উদ্দেশে রওনা করি। অর্ধেক রাস্তা যেতেই মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়। ভাদ্রের শেষে যেন শ্রাবণের ধারা!
দুপুর ১২টায় মাধবপুর পৌঁছলাম। জুমার নামাজ ও লাঞ্চ শেষে বৃষ্টি উধাও হলে বিকেল ৩টায় পৌরসভার নবনির্মিত গরুর হাট উদ্বোধন করি। বাজারটি আধুনিক সুযোগসুবিধাসহ প্রায় ৫ বছর পর আগে প্রতিষ্ঠিত হলেও স্থানীয় রাজনীতি ও দলাদলির কারণে এতদিন চালু হয়নি। আজকের অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গে এসপি রফিকুল ইসলাম ও সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনিরুল ইসলাম আখন্দ বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন। হাট উদ্বোধন শেষে বিকেল ৫টায় নিজ বাসায় ফিরে আসি। আজ বৃষ্টির কারণে টেনিস মাঠ খেলার উপযোগী ছিল না। আমি সন্ধ্যার পর থেকে বাসভবনের অফিসে বসে পেন্ডিং কাজকর্ম করি।
পরের দিন আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষ্যে সকাল ১১টায় পিটিআই হলে এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। আমি সে সেমিনারে যোগদান করি। সেখান থেকে সুতাং বাজারে বিবিএস ফাউন্ডেশন ও সুতাং থিয়েটার কর্তৃক আয়োজিত বৃক্ষচারা বিতরণ অনুষ্ঠানে যোগদান করি। সকাল থেকেই বৃষ্টি ঝরছিল। সে বৃষ্টির মধ্যে উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ লোকজনের মধ্যে চারা বিতরণ করে বিকেল সাড়ে ৩টায় বাসায় ফিরে আসি। দিনের আলো আজ বিকেল না হতেই বৃষ্টির কাছে পুরোপুরি পরাজিত। সন্ধ্যার আগেই রাতের অন্ধকার নেমে আসে। সারারাত মুষলধারায় বৃষ্টি হয়। বর্ষার শেষে আবার খোয়াই নদী ফুঁসে ওঠে। তবে রক্ষা ভোর হওয়ার সাথে সাথে বৃষ্টির প্রচন্ডতা থেমে যায়।
১০ সেপ্টেম্বর ২০০৭, সোমবার। আকাশটা ফুরফুরে মেজাজে ঝলমলিয়ে ওঠে। বৃক্ষরাজির সবুজ সতেজ নির্মল পাতারা সব সূর্যের আলোতে ঝিকমিকিয়ে হাসে। পরিবেশের স্যাঁতসেঁতে ভাব কেটে যায়। আমি সকাল ৯টায় অফিসে যাই। ১০টায় জাতিসংঘের ইউএনডিপি, বাংলাদেশের টিম লিডার মিস শর্মিতা বড়–য়া আসেন। তিনি হবিগঞ্জ জেলায় উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং আমার সহযোগিতা চান। আমি তাঁকে স্থানীয়ভাবে যথাসম্ভব সহযোগিতার আশ্বাস দিলে তিনি চা-নাশতায় আপ্যায়িত হয়ে একরকম সন্তুষ্টি নিয়ে চলে যান।
সকাল ১১টায় বানিয়াচং উপজেলা সদরে যাই। সেখানে উপজেলা পরিষদ মাঠে দেশীয় মারণাস্ত্র- ফিকল, শলা, টেটা, তীর-ধনুক, রামদা ইত্যাদি জমাদান অনুষ্ঠানে যোগদান করি। মাঠে স্তূপীকৃত এসব অস্ত্র দেখে চোখ ছানাবাড়া হয়ে যায়! ইউএনও জানালেন- তালিকা অনুযায়ী এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার বিভিন্ন জাতের অস্ত্র জমা পড়েছে, আরও নাকি আছে। বানিয়াচং উপজেলার ১৫ ইউপি চেয়ারম্যান উপস্থিত থেকে স্ব স্ব ইউনিয়নের পক্ষে তালিকা ধরে এই অস্ত্রসমূহ আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দেন। বাকি অস্ত্রও উদ্ধার করে প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময়ানুযায়ী আগামী ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জমা দিবেন বলে জানান। একটি উপজেলায় এত দেশীয় মারণাস্ত্র থাকতে পারে তা অবিশ্বাস্য বটে! জেলায় কর্মরত সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনিরুল ইসলাম আখন্দের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে এই জমাদান অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। হবিগঞ্জ তথা হাওড় এলাকার ঘরে ঘরেই এইসব দেশীয় অস্ত্র সংরক্ষণ করা হয়। আর তুচ্ছ বিষয় বা ছুতানাতার অজুহাতে সংঘর্ষে লিপ্ত জনগণ এই অস্ত্র অহরহ ব্যবহার করে থাকে। এসব অস্ত্রে প্রতিবছরই অনেক হতাহত হয়।
আমাদের উপস্থিতিতেই দাহ্য অস্ত্রসমূহে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে পোড়ানো হয়। আর ধাতব অস্ত্রসমূহ কামার ডেকে পিটিয়ে বিকৃত করে বস্তায় ভরে আপাতত একটি গোডাউনে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অস্ত্র জমা নেওয়া ও পোড়ানো দেখার জন্য একরকম মেলা জমে যায়। পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বিষয়টি বেশ গুরুত্বসহকারে প্রচার করে।
বিকেল ৪টায় হবিগঞ্জ জালাল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ‘জেলা প্রশাসক গোল্ড কাপ’ ফাইনাল খেলা দেখতে যাই। হবিগঞ্জ সদর ও নবীগঞ্জ উপজেলার মধ্যে ফাইনাল খেলা হয়। উভয় দলই বেশ কয়েকজন জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড় হায়ার করে আনে। এদের মধ্যে ২-৩ জন আফ্রিকান জিমকালো নিগ্রো খেলোয়াড় থাকায় দর্শকদের বাড়তি আনন্দ জোগায়। সর্বোপরি সুন্দর-পরিছন্ন খেলা দেখে দর্শকগণ বিমোহিত হন। এ খেলায় হবিগঞ্জ সদর ২-১ গোলে নবীগঞ্জকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়নের গৌরব অর্জন করে। পুরস্কার বিতরণ শেষে সন্ধ্যা ৬টায় বাসায় ফিরে আসি।
১২ সেপ্টেম্বর ২০০৭, বুধবার। আজ সকালে অফিসে গিয়ে এদিক সেদিক তাকানোর কোনো যো ছিল না। পূর্বনির্ধারিত জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভাসহ একাদিক্রমে মোট আটটি মাসিক সভা করি। মাঝে শুধু একঘণ্টা লাঞ্চের বিরতি ছিল। এরমধ্যে জেমস্ ফিনলে কোম্পানির দারাগাও চা বাগানের ম্যানেজার এসে তাঁর বাগানে আজ রাতে যে আমার দাওয়াত আছে, তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছেন। অফিস শেষে বাসায় আসার পর বেশ ক্লান্ত বোধ করছিলাম। বাগানের দাওয়াতে আজ না যেতে পারলে বেঁচে যেতাম; কিন্তু উপায় নেই। জেলা প্রশাসককে ঘিরেই যেন বাগানের পার্টি। তদুপরি এসপি ও সিও সাহেবও দাওয়াতি। আর বাগানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়াও আশেপাশের বাগানের ম্যানেজারগণও থাকছেন। এ দাওয়াত তো শুধু সাধারণ দাওয়াত না, রীতিমতো জম্পেশ নাইট পার্টি।
আমি রাত সাড়ে ৮টায় দারাগাও চা বাগানে উপস্থিত হলাম। সেখানে আগে থেকেই কোম্পানির সিইও, জিএম, ডিজিএম, ম্যানেজার ছিলেন। এছাড়া অন্যান্য বাগানের আমন্ত্রিত ম্যানেজারগণ প্রায় সবাই উপস্থিত হয়েছেন। বারবিকিউ প্রস্তুত হচ্ছিল। আমি যাওয়ার পরপরই অ্যাপেটাইজার হিসেবে তা পরিবেশন শুরু হয়। বাগানের ম্যানেজারের বাংলোর উন্মূক্ত বারান্দার এক কোনায় একজন তরুণ শিল্পী গিটার বাজিয়ে ইংরেজি-বাংলা সংগীত একের পর এক পরিবেশন করে যাচ্ছেন। সেদিকে কারো মনোযোগ আছে বলে মনে হলো না। সবাই খাওয়া আর খোশগল্পে মশগুল। তবে সংগীত ‘ব্যাকরাউন্ড মিউজিক’ হিসেবে ডিনার পার্টির বাড়তি জৌলুশ বৃদ্ধি করেছে তাতে সন্দেহ নেই। বাগানে এমন পার্টি হরহামেশাই হয়ে থাকে।
বিখ্যাত জেমস্ ফিনলে কোম্পানির বাংলাদেশে ৮টি চা বাগান রয়েছে। তন্মধ্যে হবিগঞ্জের বাহুবলেই দুটি। আর এই দারাগাও বাগানের বৈশিষ্ট হলো- বর্তমানে এ বাগানেই দেশের একমাত্র গ্রিন টি উৎপাদন করা হয়।
আকাশটা বেশ পরিষ্কার। আর ঝিরিঝিরি শারদীয় হাওয়ায় পার্টি বেশ জমে ওঠে। আর সেইসাথে রাতও বাড়তে থাকে। ডিনার শেষে বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে নতুন তারিখ শুরু হয়ে যায়।
১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৭, শুক্রবার। আজ পহেলা রমজান। সারাদিন বাসাতেই ছিলাম। সকালে বাসভবনের অফিসে বসে গতকালের ডাক ফাইল দেখছিলাম। এতে আমার একটি ব্যক্তিগত পত্র পেলাম। পত্রটি বাংলাদেশ টেলিভিশন কার্যালয় থেকে এসেছে, যাতে আমার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন গীতিকার হিসেবে আমাকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, আমি বাংলাদেশ বেতারেরও একজন তালিকাভুক্ত গীতিকার।
১৭ সেপ্টেম্বর ২০০৭, সোমবার। সকাল ১০টায় এডিএমকে সাথে নিয়ে জেলা কারাগার পরিদর্শনে যাই। কারাগারের পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডসমূহ ঘুরেফিরে দেখি। বন্দিদের ভালোমন্দের খোঁজখবর নিই। রান্নাঘরে গিয়ে আজকের খাবারের প্রস্তুতি অবজার্ভ করি। ইফতারি ও রাতের খাবারের কাটাবাছা চলছিল। আর কিছু অরোজাদার ও রোগীদের জন্য পৃথকভাবে রান্না হচ্ছিল। রান্নাঘরে মাছির কিছু উপদ্রব থাকলেও তা মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। কারাগার পরিদর্শন শেষে সাড়ে ১১টায় নিজ অফিসে ফিরে আসি। চলবে…
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com